Monday, January 17, 2011

নরসিংদীর ২০ কিলোমিটার মহাসড়ক যেন মৃত্যুর মহাফাঁদ

রসিংদীর সদর উপজেলার ভেলানগর থেকে রায়পুরা উপজেলার নারায়ণপুর পর্যন্ত ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ২০ কিলোমিটার অংশে গত দুই বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় দেড় শতাধিক লোক নিহত এবং আহত হয়েছে পাঁচ শতাধিক। শুধু শিবপুর বিসিক শিল্পনগরীর পাশের মহাসড়কে রাস্তা পারাপারের সময় মারা গেছেন আদুরী অ্যাপারেলস নামের তৈরি পোশাক কারখানার ৩২ জন শ্রমিক।

পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন আরো অনেকে। সর্বশেষ গত শনিবার ঘাসিরদিয়া এলাকায় ট্রাকের সঙ্গে পুলিশের পিকআপ ভ্যানের মুখোমুখি সংঘর্ষে ৯ পুলিশ সদস্যের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে।
প্রায় নিয়মিত দুর্ঘটনার কারণে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে যাতায়াতকারী বিভিন্ন পরিবহনের যাত্রীসহ নরসিংদীবাসীর কাছে এ এলাকা মৃত্যুফাঁদ হিসেবেই পরিচিত হয়ে গেছে। সম্প্রতি অল্প সময়ের ব্যবধানে কয়েকটি বড় দুর্ঘটনা যাত্রীদের আরো ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলেছে।
পুলিশের সূত্র জানায়, নরসিংদীতে গত দুই বছরে বিভিন্ন সড়ক দুর্ঘটনায় ৮৭টি মামলা হয়। এসব দুর্ঘটনায় ১৫০ জনের বেশি মারা গেছে। বেশির ভাগ দুর্ঘটনা ঘটেছে মহাসড়কের নরসিংদীর ভেলানগর থেকে বেলাব উপজেলার নারায়ণপুর অংশে। কিছু দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে মামলা না হওয়ায় সেগুলো কর্তৃপক্ষের হিসাবের বাইরে থেকে যায়।
কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ৭ আগস্ট ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার কোন্দালপাড়ায় বাস-ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে ছাত্রসহ সাতজন নিহত হয়। আহত হয় অন্তত ২০ জন। গত ২ আগস্ট নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার কুমড়াদী নামক স্থানে যাত্রীবাহী টেম্পো ও মালবাহী ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে একই পরিবারের চারজনসহ পাঁচজন নিহত হয়। গত ১৬ মে একই উপজেলার কারারচরে ঈশা খাঁ পরিবহনের একটি বাসের সঙ্গে চলনবিল পরিবহনের বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে ঘটনাস্থলেই ছয় যাত্রী নিহত হয়। আহত হয়েছে অন্তত ৫০ জন। গত ১৭ জুন একই উপজেলার শ্রীফুলিয়া বাসস্ট্যান্ড-সংলগ্ন এলাকায় চলনবিল পরিবহনের (ঢাকা মেট্রো-ব-১১-৩৮২৬) একটি বাসের সঙ্গে বিপরীত দিক থেকে আসা চালবোঝাই ট্রাকের (ঢাকা মেট্রো-ড-২৪৭০) মুখোমুখি সংঘর্ষে ঘটনাস্থলেই নাবিলা তাহসিন সরকার নামের মেডিক্যাল কলেজছাত্রীসহ চারজন নিহত হন। আহত হয় আরো ২০ যাত্রী। ৩০ জুন ওই উপজেলার কুন্দারপাড়া এলাকায় চলনবিল পরিবহনের বাসের সঙ্গে পিকআপের সংঘর্ষে কলেজছাত্রীসহ ১০ জন মারা যায়। আহত হয় আরো ২০ জন। গত ১৪ জুন মহাসড়কের পাঁচদোনার ভাটপাড়া এলাকায় চলনবিল পরিবহনের যাত্রীবাহী বাসের চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললে বাসটি সড়কের পার্শ্ববর্তী খাদে পড়ে পানিতে ডুবে যায়। এতে ৩০ যাত্রী গুরুতর আহত হয়। গত ২৮ মে শিবপুর উপজেলার কুন্দারপাড়ায় এবং রায়পুরা উপজেলার নারায়ণপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় পৃথক দুর্ঘটনায় তিনজন নিহত হয়। আহত হয়েছে সাত যাত্রী। গত ২৭ মে সকালে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নরসিংদীর বেলাব উপজেলার নারায়ণপুর বাসস্ট্যান্ডের কাছে বাসের চাপায় এক সবজি ব্যবসায়ী নিহত হন। গত ৮ মে মহাসড়কের নরসিংদী এলাকায় পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয় দুজন।
পুলিশসহ একাধিক সূত্র জানায়, গত ১৬ মে শিবপুর উপজেলার কারারচর এলাকায় দুর্ঘটনায় নিহত ছয়জনের মধ্যে চলনবিল গাড়ির চালক ছিলেন গাজীপুরের জয়দেবপুর উপজেলার পশুগাঁও গ্রামের আবদুল ছালামের ছেলে জান্নাত। ৩০ জুন একই উপজেলার কুন্দারপাড়া এলাকায় চলনবিল পরিবহনের বাসের সঙ্গে পিকআপের সংঘর্ষে কলেজছাত্রীসহ ১০ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় চলনবিলের চালক ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার দাওয়াতপুর গ্রামের মৃত আবদুল মালেকের ছেলে সাহাদাত হোসেন (৩৫)। পুলিশ উভয় দুর্ঘটনায় চালকদের দায়িত্বহীনতাকে দায়ী করেছে। অভিযুক্ত চালকরা বর্তমানে জামিন নিয়ে আবারও চলনবিলের গাড়ি চালাচ্ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত এক বছরের ব্যবধানে শুধু ঢাকা থেকে ভৈরবগামী চলনবিল পরিবহনের বেপরোয়া চালকদের কারণে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান একজন মেডিক্যাল কলেজছাত্রীসহ ২৬ জন। আহত হয় শতাধিক। শুধু চলনবিল পরিবহনই নয়, এ মহাসড়কে যাতায়াতকারী বিভিন্ন পরিবহনের বাসসহ অন্যান্য যানবাহনের বেপরোয়া চলাচলের কারণে দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
পুলিশ প্রশাসন ও নিরাপদ সড়ক চাই সংগঠনের একাধিক সংগঠকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সড়ক দুর্ঘটনার জন্য চারটি পক্ষ সমানভাবে দায়ী। পক্ষগুলো হলোÑপথচারী, চালক, মালিক ও সরকার। তাদের যেকোনো একটি পক্ষের অসাবধানতা ও দায়িত্বহীনতার কারণে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। এ ছাড়া মহাসড়কে বিভিন্ন গতির গাড়ির চলাচল, লেন না থাকা, অসম প্রতিযোগিতা, যাত্রীদের অসচেতনতা, পরিবহন মালিকদের অতি মুনাফা এবং যোগাযোগব্যবস্থার ওপর নিয়মিত মনিটরিং না থাকার কারণে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে।
নিরাপদ সড়ক চাই কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আলাল উদ্দিন বলেন, ‘ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে ঘন ঘন সড়ক দুর্ঘটনায় আমরা উদ্বিগ্ন। এ মহাসড়কের ঢাকা থেকে ভৈরব পর্যন্ত অংশে অল্প কয়েক দিনের ব্যবধানে অর্ধশতাধিক লোক নিহত হয়েছে। এগুলোর অধিকাংশই চলনবিল পরিবহনের যাত্রীবাহী বাসের সংঘটিত দুর্ঘটনা। মহাসড়কে চলাচলরত বিভিন্ন পরিবহনের গাড়িগুলোর অধিকাংশই ফিটনেসবিহীন, যাত্রীদের বীমা নেই এবং আহতদের কোনো ক্ষতিপূরণ প্রদানের ব্যবস্থা নেই।’
চলনবিল পরিবহনের চেয়ারম্যান এস এম শহীদুল হক বলেন, ‘একজন চালক ১৫ থেকে ১৬ বছর ধরে গাড়ি চালাচ্ছে। অসাবধানতার কারণে দুর্ঘটনা ঘটেÑএটা সত্য। কিন্তু একটি ঘটনায় প্রমাণিত হয় না তারা অযোগ্য। আর আমাদের পক্ষেও চালকদের ওপর নজরদারি করা কষ্টকর।’
নরসিংদী জেলা হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, ‘ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে কোনো সড়ক দুর্ঘটনা ঘটলেই আমাদের হাসপাতালে প্রথমে নিয়ে আসা হয়। প্রতিদিনই কোনো না কোনো দুর্ঘটনায় আহত রোগীরা এখানে চিকিৎসা নিতে আসেন। তবে সাম্প্রতিককালে দুর্ঘটনার পরিমাণ বেড়ে গেছে।’
আদুরী অ্যাপারেলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল কাদির মোল্লা বলেন, ‘গত দুই বছরে আমার কারখানার ২৭ জন শ্রমিক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। ট্রাফিক আইন না মেনে গাড়ি চালানোর কারণেই ঘন ঘন দুর্ঘটনা ঘটছে।’
দুর্ঘটনায় শনিবার ৯ পুলিশের মৃত্যু প্রসঙ্গে পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেন, প্রচলিত ট্রাফিক আইন পরিবর্তন ছাড়া কোনো উপায় নেই। সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করতে নতুন করে ভাবতে হবে। সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বিষয়টি আলোচনা করা হবে। এটা খুবই দুঃখজনক ঘটনা।
ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু বলেন, ‘ট্রাফিক আইন মেনে চালকরা গাড়ি না চালালে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।’
নরসিংদীর পুলিশ সুপার ড. আক্কাছ উদ্দিন ভূঁইয়া কালের কণ্ঠকে জানান, গত এক বছরে নরসিংদীতে সড়ক দুর্ঘটনায় ৬৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে অন্তত ৭৪ জন। তবে এর বাইরেও সড়ক দুর্ঘটনায় অনেক হতাহতের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। দুর্ঘটনা রোধে জেলার সব পরিবহন মালিক ও নেতাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে নিরাপদ সড়ক প্রতিষ্ঠার জন্য করণীয় বের করার প্রচেষ্টা চলছে।

No comments:

Post a Comment