Monday, January 17, 2011

জাতীয় প্রেসক্লাবের সদ্য সমাপ্ত নির্বাচন প্রসঙ্গে by আবদুল গাফফার চৌধুরী

ইংরেজি নতুন বছরের প্রথম দিনটিতেই ঘুম থেকে জেগে ঢাকা থেকে যে প্রথম খবরটি পেয়েছি, তাতে খুব একটা স্বস্তি পাইনি। ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবের নতুন কর্মকর্তা নির্বাচনের খবরটি আমাকে খুশি করেনি। মনে হলো নতুন বছরের পয়লা দিনে টেলিফোনে অসংখ্য হ্যাপি নিউ ইয়ার মেসেজ পেতে পেতে একটি আনহ্যাপি খবর পেলাম।

আগেই বলে রাখি কেউ যেন আমাকে ভুল না বোঝেন। নির্বাচনে কারা জিতেছেন বা কারা হেরেছেন, তার ভিত্তিতে আমার এই খুশি বা অখুশি হওয়া নয়। নির্বাচনে হার-জিত আছেই। সেদিক থেকে ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবের যারা নতুন কর্মকর্তা হিসাবে নির্বাচিত হয়েছেন তাদের আন্তরিক অভিনন্দন জানাই এবং জাতীয় প্রেসক্লাবের অতীত ঐতিহ্য এবং সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি ধরে রাখা ও বাড়ানোর কাজে তাদের সাফল্য কামনা করি।

আমার অস্বস্তিতে ভোগা ও অখুশি হওয়ার কারণ, দেশ ও জাতির অন্যতম প্রধান দিশারি বলা হয় যে সাংবাদিকদের, বাংলাদেশে তাদের একটি প্রধান কেন্দ্রের বা সংগঠনের নির্বাচন পেশাদারিত্বের ভিত্তিতে নয়, দলীয় ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হওয়ার অভিযোগ। স্বাধীনতার আগে কেবল সাংবাদিক সংগঠন নয়, পেশাজীবী কোনো সংগঠনেই যেমন শিক্ষক সমিতি, আইনজীবী সমিতি, চিকিৎসক সমিতি ইত্যাদি কোনো সমিতি-সংগঠনের মধ্যে রাজনৈতিক কোনো দলের প্রতি আনুগত্যের ভিত্তিতে বিভাজন ছিলো না। সংগঠনগুলোর সদস্য সংগ্রহ বা কর্মকর্তা নির্বাচনেও দলীয় আনুগত্য নয়, পেশাদারি যোগ্যতাই বিবেচনা লাভ করতো।

তা বলে কি সাংবাদিক, শিক্ষক বা আইনজীবীরা রাজনীতি করতেন না, তাদের নিজেদের পছন্দের রাজনৈতিক দলের প্রতি আনুগত্য দেখাতেন না? অবশ্যই দেখাতেন। দেশের প্রত্যেকটি ছোট-বড় রাজনৈতিক দলেই প্রত্যেক পেশার লোকজন ছিলো, এখনো আছে। রাজনৈতিক দলে তারা নেতৃত্বও দিয়েছেন এবং এখনো দেন। কিন্তু পেশার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক মত ও দলের আনুগত্য দ্বারা বিভক্ত ছিলেন না। সেখানে পেশাদারি সমিতিগুলো পেশার ও পেশাজীবীদের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষার লক্ষ্যকে সামনে রেখে গঠিত এবং পরিচালিত হতো। এই সংগঠনগুলোতেও রাজনৈতিক মতপার্থক্য টেনে আনলে পেশা ও পেশাজীবীদের স্বার্থ ও ঐক্য যে রক্ষা করা যাবে না এটা তারা বুঝতেন।

পাকিস্তান আমলে মিডিয়ার সম্পাদক থেকে শুরু করে সর্বস্তরের সাংবাদিকেরা রাজনীতি-নিরপেক্ষভাবে পেশাজীবী ঐক্যের গুরুত্ব বুঝতেন বলেই ঢাকায় প্রেসক্লাব ও সাংবাদিক ইউনিয়নের কর্মকর্তা নির্বাচনে বা মনোনয়নে লক্ষ্য রাখা হতো যাদের কর্মকর্তা পদে বসানো হচ্ছে, তারা মর্যাদাবান সম্পাদক অথবা সাংবাদিক কিনা অথবা সাংবাদিকদের পেশাদারি ঐক্য ও স্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রে উপযুক্ত নেতৃত্ব দেওয়ায় যোগ্যতা রাখেন কিনা?

এই বিবেচনা বাংলাদেশের সাংবাদিকদের মধ্যে সেই পাকিস্তান আমলেই অভূতপূর্ব ঐক্য গড়ে তুলেছিল এবং কেবল সাংবাদিকদের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে নয়, গণঅধিকার ও স্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রেও অগ্রণী ভূমিকা পালনে তাদের এগিয়ে দিয়েছিল। রাজনৈতিক পরিচয়ের বিবেচনায় নয়, পেশার ক্ষেত্রে নিজেদের বিরাট মর্যাদা ও নেতৃত্বগুণের জন্যই তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ও আবদুস সালামের মতো তৎকালীন সম্পাদকেরা সর্বসম্মতভাবে তখনকার ঢাকা প্রেসক্লাবের সভাপতি হতে পেরেছিলেন।

অথচ মানিক মিয়া ও আবদুস সালাম ছিলেন তখনকার পরস্পর বিরোধী রাজনৈতিক মতের দুই সংবাদপত্রের সম্পাদক। প্রতিদিন তারা পরস্পরের রাজনৈতিক মত ও কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে তীব্র তীক্ষ্ন ভাষায় কলম চালাতেন, তারপর যখন প্রেসক্লাবে আসতেন তখন তারা শুধু ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের পরিচয় দিতেন না, পরিচয় দিতেন সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, সাংবাদিকদের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষার ব্যাপারে ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধার।

পাকিস্তান আমলে শুধু ঢাকা প্রেসক্লাবের নয়, সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের সকল জেলা ও মফস্বল এলাকার প্রেসক্লাবগুলোরও একটা বিরাট প্রোপিউপল রোল ছিলো। গণঅধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে দলমত নির্বিশেষে সকল সাংবাদিকই ছিলেন একাট্টা। সেকারণে অনেক প্রলোভন এবং ভয় দেখিয়েও আইয়ুব, ইয়াহিয়া বা মোনেম খানের মতো তৎকালীন স্বৈর শাসকেরা ঢাকা প্রেসক্লাবে আসার জন্য কোনো আমন্ত্রণ পাননি এবং তারা আসতে চেয়েও আসতে পারেননি। গভর্নর মোনেম খানের কাগজ দৈনিক পয়গামের (অধুনালুপ্ত) সাংবাদিকেরাও মোনেম খানের প্রেসক্লাবে আসার ব্যাপারে বিরোধিতাকে সমর্থন দিয়েছেন।

ফলে শুধু সারা পাকিস্তানে নয়, সারা উপমহাদেশেই ঢাকার প্রেসক্লাব একটি অনন্য ভূমিকার মর্যাদা লাভ করেছিল। দিলিস্নর ইংরেজি দৈনিক প্রেট্রিয়টের এক সম্পাদক ঢাকার প্রেসক্লাব দেখে দিলিস্নতে ফিরে গিয়ে তার কাগজে লিখেছিলেন, ঢাকা প্রেসক্লাব কেবল সিটি জার্নালিস্টদের একটি কেন্দ্র নয়, এটি শহরের বুদ্ধিজীবীদেরও একটি প্রাণকেন্দ্র এবং বাঙালির জাতীয় জীবনে এর রয়েছে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এই গুরুত্বের কথা জেনেই পাকিস্তানি হানাদারেরা একাত্তর সালে মার্চের সেই ভয়াল রাতগুলোর একটিতে এই প্রেসক্লাবকেই তাদের গোলাবর্ষণের অন্যতম প্রধান টার্গেট করেছিলো।"

বিস্ময়ের কথা এই যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকা প্রেসক্লাব জাতীয় ইনস্টিটিউশনের মর্যাদায় উন্নীত হওয়ায় যেখানে এর ঐক্য ও মর্যাদা আরও বহুগুণ বেড়ে যাওয়া উচিত ছিলো, পরিবর্তে তা নিম্নমুখী হয়। আগের ভবনের বদলে নতুন সুরম্য ভবন তৈরি হয়েছে, কিন্তু স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার নতুন ইমেজ গড়ে ওঠেনি। বরং দলীয় রাজনীতির প্রতি আনুগত্য সাংবাদিকদের একটা বড় অংশের মধ্যে প্রধান্য লাভ করায় দেশের অন্যান্য পেশাজীবী সংগঠনের মতো সাংবাদিক ইউনিয়ন এবং জাতীয় প্রেসক্লাবেও অনৈক্য ও দলাদলির সূত্রপাত হয়। ফলে জাতীয় প্রেসক্লাবের যেখানে হয়ে ওঠা উচিত ছিলো সাংবাদিকতায় জাতীয় ঐক্যের প্রতীক, তা হয়ে দাঁড়ায় অনৈক্যের প্রতীক।

পৃথিবীর আর কোনো গণতান্ত্রিক দেশে সাংবাদিকেরা তো বটেই, কোনো পেশার মানুষই রাজনৈতিক দলের প্রতি আনুগত্যের ভিত্তিতে বিভক্ত নয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশে তারা বিভক্ত। সামরিক ছাউনিতে জেনারেল জিয়াউর রহমানের বিএনপি গড়ে উঠতেই পেশাজীবী সংগঠনগুলোর মধ্যে ভাঙন ও বিভক্তি শুরু হয়। গড়ে উঠতে থাকে নামের আগে জাতীয়তাবাদী ছাপ মেরে বিভিন্ন সংগঠন। কোনো সংগঠনের নামের আগে জাতীয়তাবাদী ছাপ দেখলেই বুঝতে হবে এটা বিএনপিপন্থী পেশাজীবীদের সংগঠন। জাতীয় প্রেসক্লাব এই জাতীয়তাবাদী ছাপটি লাগিয়ে এখনো বিভক্ত হয়নি। তার কারণ সম্ভবত: এটি এখনো জাতীয়তাবাদীদের কব্জায়।

আগেই বলেছি, পৃথিবীর আর কোনো গণতান্ত্রিক দেশে আইনজীবী, শিক্ষক, ব্যবসায়ী বা সাংবাদিক প্রমুখ পেশাজীবী শ্রেণী রাজনৈতিক দলের আনুগত্যের ভিত্তিতে বিভক্ত নয়। একমাত্র এই বিভক্তি ঘটেছিল গত শতকের ত্রিশের দশকে জার্মানীতে হিটলারের ন্যাশনালিস্ট সোসালিস্ট পার্টি বা নাৎসিদের শাসনামলে। নাৎসিদের প্রতি আনুগত্যের প্রমাণ হিসেবে জার্মানীর প্রত্যেকটি পেশাজীবী সংগঠন তাদের নামের আগে ন্যাশনালিস্ট বা জাতীয়তাবাদী লাগাতে বাধ্য হয়েছিলো। এমনকি জার্মানীর পতিতাদের সংগঠন (তখনও যৌনকমর্ী কথাটির প্রচলন ও ব্যবহার শুরু হয়নি) তাদের পতিতা সমিতির নামের আগে জাতীয়তাবাদী কথা লাগিয়ে জাতীয়তাবাদী পতিতা সমিতি হয়েছিলো।

কোনো ফ্যাসিস্ট দেশের এই প্রথা গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে অনুসৃত হতে পারে না এবং রাজনৈতিক দলের প্রতি আনুগত্যের ভিত্তিতে পেশাজীবী শ্রেণীগুলো বিএনপিপন্থী (জাতীয়তাবাদী) বা আওয়ামী পন্থী হিসেবে বিভক্ত ও পরিচিত হতে পারে না। যদি হয় তাহলে পেশাজীবীদের ঐক্য, স্বার্থ ও অধিকারের যেমন গুরুতর ক্ষতি হবে, তেমনি ক্ষতি হবে স্বাধীন পেশাদারিত্বের ও জাতীয় ঐক্যের। পেশাজীবীরা তাদের পছন্দমতো রাজনৈতিক দলে যোগ দিন এবং রাজনীতি করুন, গণতান্ত্রিক দেশেও কেউ তাতে আপত্তি করবে না। কিন্তু পেশার ক্ষেত্রে নিরপেক্ষভাবে শুধু পেশার স্বার্থ ও অধিকার রক্ষার লক্ষ্যেই তারা ঐক্যবদ্ধ হবেন এবং থাকবেন। তাহলেই মাত্র বৃহত্তর ক্ষেত্রে জাতীয় ঐক্য ও জাতীয় স্বার্থ রক্ষা পাবে।

আমার দুঃখ, বাংলাদেশ আজ শুধু রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত ও অবিরাম সংঘাতে লিপ্ত নয়, তারা, যে পেশাগুলো জাতীয় স্বার্থ ও অধিকার রক্ষা করে সেগুলোর ক্ষেত্রেও বিভক্ত। জাতীয় প্রেসক্লাবের সদ্য সমাপ্ত নির্বাচন দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হওয়ায় এবং যোগ্যতার ও নেতৃত্বগুণের বদলে বিশেষ দলের অনুসারীদের অধিকাংশ পদে বিজয়কে সেই দলের রাজনৈতিক বিজয় বলে প্রচারিত হওয়ায় মনে হয়, জাতিকে যারা পথ দেখাবেন, সেই সাংবাদিকদের একটা বড় অংশই সাংবাদিকতা পেশার নিরপেক্ষতার মর্যাদা রক্ষার বদলে দলীয় স্বার্থে এখনো পরিচালিত হচ্ছেন এবং পেশার ও দেশের অবর্ণনীয় ক্ষতি সম্পর্কে এখনো সচেতন হননি।

যে দু'জন প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিক (সম্পাদক) তাদের নেতৃত্ব, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা দ্বারা জাতীয় প্রেসক্লাবের পূর্ব মর্যাদা ফিরিয়ে আনতে পারতেন, তারা দু'জনেই দু'টি গুরুত্বপূর্ণ পদে পরাজিত হয়েছেন। এটা তাদের ব্যক্তিগত পরাজয় নয় এবং তাদের ব্যক্তিগত মর্যাদা ও সুনামেরও কোনো হানি হয়নি। তারা দেশের অন্যান্য পেশার ক্ষেত্রে যা ঘটেছে, সাংবাদিকতার পেশার ক্ষেত্রেও সেই বিচারবুদ্ধিহীন অশুভ দলবদ্ধতার শিকার হয়েছেন। এতে সম্পাদক দু'জনের কোনো ক্ষতি হবে না। ক্ষতি হবে দেশের সাংবাদিকতা ও প্রেসক্লাবের সুনামের।

আমাকে কয়েকজন নিরপেক্ষ সাংবাদিক বলেছেন, জাতীয় প্রেসক্লাব বর্তমানে এমনভাবে একটি দলের অনুসারীদের কব্জাবন্দি হয়ে আছে যে, কোনো অত্যন্ত জনপ্রিয় সাংবাদিকের পক্ষেও সাধারণ ও নিরপেক্ষ সাংবাদিকদের ভোটে নির্বাচিত হওয়া অসম্ভব। দল সমর্থক প্রাথর্ী যোগ্য-অযোগ্য যাই হোক তাকে জেতাতেই হবে। এই অন্ধ উন্মাদনা থেকে একটি দৈনিকের সাবেক মালিক বিদেশে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় একদিনের জন্য ঢাকায় ছুটে এসেছিলেন। আরেক প্রেসক্লাব সদস্য গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় এম্বুলেন্সে চেপে এসেছিলেন ভোট দিতে। জাতীয় প্রেসক্লাবের নির্বাচনেই যদি এই অবস্থা দাঁড়ায়, তাহলে আগামী সাধারণ নির্বাচনে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সে কথাও ভেবে দেখার মতো।

জাতীয় প্রেসক্লাবকে দলীয় কব্জা থেকে মুক্ত করে পূর্ব মর্যাদায় ফিরিয়ে আনা দেশের সাধারণ সাংবাদিকদেরই কর্তব্য। তারা পাল্টা দলীয় ভিত্তিতে নয়, সাংবাদিকতার নিরপেক্ষ পেশাদারিত্বের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হোন এবং জাতীয় প্রেসক্লাবের গঠনতন্ত্র সংশোধনসহ তার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় গণতান্ত্রিক পরিবর্তন ঘটানোর জন্য প্রচেষ্টা শুরু করুন। প্রেসক্লাব বিএনপি বা আওয়ামী লীগ কোনো দলেরই রাজনৈতিক স্বার্থে পরিচালিত হতে পারে না। জাতীয় প্রেসক্লাব পরিচালিত হবে জাতীয় সাংবাদিকতার নিরপেক্ষতা এবং পেশাদারিত্বের নিভর্ীকতার ভিত্তিতে। প্রেসক্লাব কেন, কোনো পেশাজীবী সংগঠনেরই দলদাস হওয়া উচিত নয়।

No comments:

Post a Comment