Monday, January 17, 2011

ঢাকায় অপরাধ বাড়ছে-ভাড়াটে সন্ত্রাসীরা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে

দাগি অপরাধীরা কারাগার থেকে বের হয়ে আসতে শুরু করেছে। গত ছয় মাসে শুধু ঢাকা মহানগর এলাকাতেই এক হাজারের বেশি অপরাধী ছাড়া পেয়েছে। এদের অনেকেই ভাড়াটে সন্ত্রাসী হিসেবে অপরাধ করছে। পুলিশের ধারণা, এদের কারণে রাজধানীতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, চলমান পৌরসভা নির্বাচন এবং আসন্ন ইউপি ও সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে ঘিরে মুখচেনা অপরাধীদের কারাগার থেকে বের করে আনার রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক সমর্থন না থাকলে এসব আসামির পক্ষে জামিন পাওয়া সম্ভব নয় বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান।
পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ছয় মাসে শুধু ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন থানায় খুন, ডাকাতি, দস্যুতা, দ্রুত বিচার আইনের মামলা, বিস্ফোরক অপরাধ ও সন্ত্রাসবিরোধী মামলায় গ্রেপ্তার করা এক হাজার ৭২ জন আসামি ছাড়া পেয়েছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন গত শুক্রবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফজলুল হকের লাশ দেখতে গিয়ে সংবাদিকদের বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি হয়েছে। এর আগে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে খুন, ডাকাতির একাধিক ঘটনা ঘটলেও আইনশৃঙ্খলার অবনতির কথা সরকার স্বীকার করেনি। গত বৃহস্পতিবার এফবিসিসিআই মিলনায়তনে আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত ব্যবসায়ীদের সভায় পুলিশের কাজে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধের প্রয়োজনের কথা বলেন সংগঠনের সভাপতি এ কে আজাদ। ব্যবসায়ীরা পুলিশের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর তাগিদ দেন। এর আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠকে সংগঠনের পক্ষ থেকে চলমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
নতুন বছর শুরু হতেই হঠাৎ রাজধানীসহ সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। জানুয়ারির প্রথম ১৫ দিনে শুধু রাজধানীতেই ২২টি খুন ও ছয়টি বড় ধরনের ডাকাতি হয়েছে। ছিনতাইয়ের ঘটনাও অসংখ্য। এসব নিয়ে জনজীবনে বিরাজ করছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়া, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সন্ত্রাসীদের প্রতি রাষ্ট্রের নমনীয়তা প্রদর্শন ইত্যাদিও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণ।
যোগাযোগ করা হলে স্বরাষ্ট্রসচিব আবদুস সোবহান সিকদার আইনশৃঙ্খলার কিছুটা অবনতির কথা উল্লেখ করে বলেন, উপদলীয় কোন্দল, পারিবারিক-সামাজিক নানা বিরোধে কিছু খুনখারাবি হতে পারে। এসব বিষয় আগে থেকে আঁচ করা সম্ভব নয়।
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, দু-একটি বড় খুনের ঘটনা ঘটেছে বটে, কিন্তু এটা সর্বব্যাপী নয়। এসব অপরাধের পেছনে মাদক, ব্যক্তিগত শত্রুতা, তাৎক্ষণিক উত্তেজনা, স্বার্থগত দ্বন্দ্ব কাজ করতে পারে। সব মিলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণেই আছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের কর্মকর্তারা বলেন, নানা কারণে তাঁদের কাজেও শৈথিল্য আছে। যানবাহনের সংকট, পরিদর্শকদের প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা না দেওয়া, পৌর নির্বাচনে ব্যস্ততাসহ বেশ কিছু কারণে পুলিশের কাজে কিছুটা গা ছাড়া ভাব লক্ষণীয়। এ ছাড়া শীতের কারণে রাজধানীর রাস্তায় পুলিশের টহল কমে গেছে। পথে পথে তল্লাশি চৌকি নেই বললেই চলে। পায়ে হেঁটে পাহারা ও সাদা পোশাকের টহলও বন্ধ। এভাবে পুলিশি তৎপরতা থেমে যাওয়ার সুযোগেও বেড়ে গেছে সন্ত্রাসীদের আগাগোনা ও অবৈধ অস্ত্র বহন। বেশির ভাগ পুলিশ, র্যাব, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন, আনসার এখন পৌর নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত।
ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের মুখপাত্র ও গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, এমনিতেই শীতের সময় অপরাধ বাড়ে। গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসেও এভাবে অপরাধ কিছুটা বেড়েছিল। অল্প দিনের মধ্যে তা ঠিক হয়ে যায়। এবার শীতেই তেমন কিছু ঘটনা ঘটেছে। তবে সব ঘটনাই বিচ্ছিন্ন, একটির সঙ্গে আরেকটির যোগসূত্র নেই।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে এক হাজার ২২ জন অপরাধী ছাড়া পেয়েছে। কেউ জামিনে, আবার রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা প্রত্যাহারের কারণেও অনেকে ছাড়া পাচ্ছে। এসব অপরাধীর মধ্যে ডাকাতি মামলায় ১৩৭, খুনের মামলায় ২৮১, ছিনতাই ও দস্যুতার মামলায় ২৪০, অস্ত্র মামলায় ২৭৯, বিস্ফোরক মামলায় আট, অজ্ঞান পার্টির সদস্য ৪৮, গাড়ি চুরির মামলায় ১০ ও সন্ত্রাসবিরোধী অধ্যাদেশে আটক করা ১৯ জন রয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার বেনজীর আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ খতিয়ে দেখছে, কী কারণে দাগি আসামি বেরিয়ে যাচ্ছে। এই সন্ত্রাসীরাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নতুন করে অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে। তিনি বলেন, একটি প্রতিবেদন তৈরি করে সরকারকে দেওয়া হবে, যাতে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিরা জামিনের বিরোধিতা করতে পারেন।
মাঠপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ভেতরে এখন গা ছাড়া ভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা মাঠপর্যায়ে ঠিকমতো অনুসরণ করা হচ্ছে না। পুলিশের কর্মকর্তাদের মতে, এনকাউন্টার বা ক্রসফায়ারের ঘটনা সমালোচিত হওয়ায় র্যাবের কাজেও শৈথিল্য লক্ষ করা যাচ্ছে।
ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহ আলম জানান, দুটি কারণে অপরাধ বাড়ছে। একটি হলো, অপরাধীদের মুক্ত হওয়ার ঘটনা বেড়ে গেছে। অন্যটি হলো, পুলিশের টহল কমে যাওয়া।
সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার খুন হলেন ৪১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফজলুল হক। এই খুনের ঘটনায় ভাড়াটে খুনি ব্যবহূত হয়েছে বলে পুলিশের ধারণা। ১ জানুয়ারি রাতে মিরপুরে গুলিতে নিহত হন জাতীয় অন্ধ সংস্থার মহাসচিব এম কে খলিলুর রহমান। তাঁকেও ভাড়াটে খুনিরা হত্যা করে। ৪ জানুয়ারি রাতে কদমতলীর মুরাদপুর হাইস্কুল সড়কে হাজি ফজর আলীর বাড়িতে ডাকাতি হয়। একই দিন সকালে রাজধানীর বিজয় সরণিতে গুলিবিদ্ধ হন ব্যবসায়ী ইমারত হোসেন। ৫ জানুয়ারি সন্ধ্যায় খিলগাঁওয়ের মেরাদিয়া এলাকায় এক বাসায় হামলা চালিয়ে ডাকাতেরা কয়েক লাখ টাকা লুট করে। ওই সময় গুলিবিদ্ধ হন রাশেদুল হক নামের এক গৃহকর্তা। ৮ জানুয়ারি রাতে পল্লবীতে সংরক্ষিত আসনের মহিলা সাংসদ শাহিদা তারেখ দীপ্তির বাসায় ডাকাতি হয়। ডাকাতেরা সেখান থেকে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা ও ৬৫ ভরি স্বর্ণালংকার লুট করে।
৯ জানুয়ারি কল্যাণপুরে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে নিজাম উদ্দিন খানকে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। একই দিন দুপুরে ইন্দিরা রোডের এক বাসায় মা ভার্জিনিয়া রোজারিওকে শ্বাসরোধে আর ছেলে ভ্যালেন্টাইন রোজারিও মিল্টনকে জবাই করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনায় পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, ভাড়াটে সন্ত্রাসীদের হাতে তাঁরা খুন হয়েছেন। ১০ জানুয়ারি ঢাকার মতিঝিলে যুবদলের নেতা শহিদ মোল্লাকে সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করে। এ ক্ষেত্রে ভাড়াটে খুনিদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠেছে। ১৩ জানুয়ারি বাড্ডায় অজ্ঞাত এক যুবককে গুলি করে হত্যা করা হয়। ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক এলাকায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে একজন মোটর পার্টস ব্যবসায়ী আহত হন। ঢাকার বাইরে যশোরের মনিরামপুর, নাটোর, পল্লবীতে কলেজছাত্র খুন; নবাবগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, জগন্নাথপুর, কক্সবাজার, বান্দরবান, রামুতেও ডাকাতি হয়।
সূত্র জানায়, পুলিশ সপ্তাহ শেষ হওয়ার পর থেকেই পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে গা ছাড়া ভাব দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে ওসিদের প্রথম শ্রেণী ও সার্জেন্ট-সাব ইন্সপেক্টরদের দ্বিতীয় শ্রেণীতে উন্নীত না করা নিয়ে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। মাঠপর্যায়ে এর প্রভাব পড়েছে বলেই মনে করছেন অনেকে। তবে একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, এখন সন্ত্রাসীদের তৎপরতা পর্যবেক্ষণ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। কারা জামিন পাচ্ছে, কারা পাচ্ছে না, সে খবর কেউ রাখে না। তা ছাড়া অস্ত্র কেনাবেচার সর্বশেষ তথ্যও কারও হাতে নেই। এ কারণে সন্ত্রাসীদের গতিবিধির ব্যাপারে কারও কাছে কোনো তথ্য নেই।
জানতে চাইলে ওয়ারী অঞ্চলের উপকমিশনার গাজী মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, শীতের কারণে পুলিশের অনেক গাড়ি অচল হয়ে পড়েছে। আবার আদালতের নির্দেশে পুলিশ গাড়ি রিকুইজিশন করতে পারছে না। গাড়ি না থাকায় শীতের রাতে পায়ে হেঁটে টহল দেওয়া কমে যাচ্ছে। এ ছাড়া থানায় এত দিন যে সাদা পোশাকের টহল ছিল, তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সাদা পোশাকের পুলিশের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আসায় এসব বন্ধ করে দেওয়া হয়।

No comments:

Post a Comment