Sunday, May 15, 2011

নওয়াজের চাপে নত সরকার by হামিদ মির

পাকিস্তানে গত শুক্রবার যখন পার্লামেন্টের যৌথ অধিবেশন চলছিল, তখন সেখান থেকে কয়েক শ মাইল দূরে রাইউইন্ড শহরে নিজের বাসায় ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) দলের প্রধান নওয়াজ শরিফ। তার পরও সেখান থেকেই তিনি সরকারকে বারবার চাপ দিচ্ছিলেন, ২ মে অ্যাবোটাবাদে মার্কিন বাহিনীর অভিযানের ঘটনা তদন্তে একটি নিরপেক্ষ কমিটি গঠনের জন্য।

ওই সময়ে তিনি নিজের দলের নেতা চৌধুরী নাসির আলী খান ও ইসহাক দারকে ১২ বারের বেশি টেলিফোন করেন। নিরপেক্ষ কমিশন গঠনে সরকারের দিক থেকে বেশ অনীহা ছিল। কেননা পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ইতিমধ্যে ঘটনা তদন্তের একটি ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু নওয়াজ শরিফ গত বুধবারই সেনাবাহিনীর এ তদন্ত নাকচ করে দেন। এ ছাড়া আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য সরকারকে চাপ দেন তিনি। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো মার্কিন ড্রোন (চালকবিহীন বিমান) হামলা।
দলীয় নেতাদের নওয়াজ শরিফ জানিয়ে দেন, আবারও ড্রোন হামলা হলে আফগানিস্তানে ন্যাটো বাহিনীর রসদ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়টি যদি প্রস্তাবে থাকে, কেবল তখনই ওই প্রস্তাবে সম্মতি দেওয়া যাবে। এমনকি তিনি প্রস্তাবের দাঁড়ি, কমা, পূর্ণচ্ছেদ পর্যন্ত ধরে ধরে অবহিত করেন নেতাদের।
পার্লামেন্টের প্রায় ১০ ঘণ্টা অধিবেশনের পর গতকাল শনিবার একটি প্রস্তাব গ্রহণ করেন পাকিস্তানি আইনপ্রণেতারা। ওই প্রস্তাবে শুধু একতরফা মার্কিন অভিযানের নিন্দাই করা হয়নি, এতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের বিষয়টি নতুন করে পর্যালোচনারও আহ্বান জানানো হয়েছে। ইসলামাবাদে নিযুক্ত একজন ইউরোপীয় শীর্ষ কূটনীতিক বলেছেন, ‘পাকিস্তানের ৬৪ বছরের ইতিহাসে এই প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিপর্যয়।’
পার্লামেন্টে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত এই অনাকাঙ্ক্ষিত প্রস্তাবের ফলে ইসলামাবাদের কূটনৈতিক মহলের মধ্যে বেশ উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। পাকিস্তান-মার্কিন সম্পর্ক সবচেয়ে ভয়াবহ কী অবস্থায় পৌঁছাতে পারে, তা পর্যালোচনা করে মূল্যায়ন প্রতিবেদন পাঠানোর জন্য ইসলামাবাদে নিযুক্ত কূটনীতিককে নির্দেশ দিয়েছে বিশ্বের ক্ষমতাধর বিভিন্ন দেশ। অনেক কূটনীতিক এখন বোঝার চেষ্টা করছেন, এখন পাকিস্তানে যদি আবারও ড্রোন হামলা হয়, তাহলে কী ঘটতে পারে। পাকিস্তান সঙ্গে সঙ্গে ন্যাটোর সরবরাহ পথ বন্ধ করে দেবে? বেশির ভাগ কূটনীতিক নিশ্চিত, পাকিস্তান এখন তা-ই করবে। কেননা পাকিস্তানের সরকার ও সেনাবাহিনীর এখন দেশের মানুষের কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা পুনরুদ্ধার করতে হবে।
জানা গেছে, অনেক পশ্চিমা কূটনীতিক ইতিমধ্যে তাঁদের দেশকে জানিয়ে দিয়েছেন, পাকিস্তানের পার্লামেন্ট দেশের সেনাবাহিনীকে পূর্ণাঙ্গ সমর্থনই দিয়েছে এবং আইএসআই এখন একা নয়। ১০ ঘণ্টার অধিবেশনের প্রথম তিন ঘণ্টায় অনেক কঠিন প্রশ্নের জবাব দিতে হয়েছে আইএসআইয়ের প্রধানকে। কিন্তু এরপর পাকিস্তান মুসলিম লীগ (এন) নেতা জাভেদ হাশমি, সাদ রফিক ও ইশহাক দার তাঁদের বক্তব্যে এটা পরিষ্কার করেছেন যে তাঁরা এত সব প্রশ্ন তুলছেন কোনো খারাপ উদ্দেশ্যে নয়, ভালোর জন্যই।
জাভেদ হাশমি বলেন, ‘পার্লামেন্ট আপনাদের মায়ের মতোই। এখানে আপনাদের প্রশ্ন করার অধিকার আমাদের আছে। তাই বলে বাইরের কাউকে আপনাদের ওপর দোষারোপ করার সুযোগ আমরা দেব না।’ দেশের ৬৪ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম জবাবদিহির স্বার্থে পার্লামেন্টের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন আইএসআইয়ের প্রধান।
রাজনীতিতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ভূমিকা নিয়ে গত শনিবার বিকেলে নওয়াজ শরিফ বেশ কঠোর মন্তব্য করেন। নওয়াজ পরিষ্কার করে দেন, তিনি সেনাবাহিনীর বিপক্ষে নন, তবে অবশ্যই রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর নাক গলানোর বিরুদ্ধে। পিপিপির মন্ত্রী ফেরদৌস আশিক আওয়ান অবশ্য চেষ্টা করেছিলেন নওয়াজ এই বক্তব্যকে একটু অন্যভাবে ব্যবহার করতে। কিন্তু তাঁর সেই উদ্যোগ ভেস্তে যায়। পার্লামেন্টের অনেক সদস্যই লক্ষ করেছেন, ক্ষমতাসীন পিপিপির সদস্যরা সেনা নেতৃত্ব ও নওয়াজের দলের মধ্যে একটা উত্তেজনা তৈরির চেষ্টা চালিয়ে গেছেন।
উপজাতি-অধ্যুষিত এলাকা থেকে নির্বাচিত পার্লামেন্ট সদস্য মুনির ওরাকজাইয়ের অভিযোগ, ‘আইএসআইয়ের মহাপরিচালককে যখন পিএমএল(এন) নেতা চৌধুরী নিসার আলী খান প্রশ্ন করছিলেন, তখন পিপিপির সদস্য ফৌজিয়া ওহাব পিএমএল(কিউ) সদস্যদের নিয়ে এর বিরুদ্ধে স্লোগান দেওয়ার ষড়যন্ত্র করেছেন।’ এসব সত্ত্বেও অধিকাংশ পার্লামেন্ট সদস্য খুশি এই কারণে যে তাঁরা শেষ পর্যন্ত একটা মতৈক্যে পৌঁছাতে পেরেছেন।
পার্লামেন্টে গৃহীত সর্বসম্মত প্রস্তাবের ব্যাপারে দুই বড় দলের (পিপিপি ও পিএমএল-এন) অভিন্ন অবস্থানে অনেক কূটনীতিকই বিস্মিত। তাঁরা ভেবেছিলেন, এই বিষয়ে দুই দলের মধ্যে পার্লামেন্টে বেশ জোরালো মতানৈক্য ও বাক্যবিনিময় হবে। এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে, ২ মের (বিন লাদেনের হত্যার দিন) ঘটনার তদন্তে স্বাধীন কমিশন গঠনের ব্যাপারে সরকারপক্ষ কবে নওয়াজের দলের সঙ্গে আলোচনা শুরু করবে। প্রধানমন্ত্রী গিলানির ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো জানাচ্ছে, ‘আমরা গোটা জাতির কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। তাই এ থেকে সরে আসার কোনো উপায় নেই আমাদের। শিগগিরই এ ব্যাপারে আমরা কাজ শুরু করব।’
গতকাল এক কূটনীতিক চুপিচুপি ইসলামাবাদে এক মন্ত্রীর বাসভবনে গিয়েছিলেন। ওই কূটনীতিক জানতে চান, আসলেই ন্যাটোর সরবরাহ লাইন বন্ধ করে দেওয়ার ব্যাপারে সরকার কতটা কঠোর অবস্থানে আছে। ওই মন্ত্রীর জবাব ছিল এ রকম, ‘কিছুদিনের মধ্যে সব দল নির্বাচনের মুখোমুখি হতে চলেছে। তাই আমরা আর ভোটারদের সামনে পুরোনো তামাশা দেখাতে পারি না। ওই দিন শেষ। এখন আমরা যদি ন্যাটো বা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিই, তবে ভোটাররাই ধর্মীয় দলগুলোকে ভোট দিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। তার চেয়ে দয়া করে যুক্তরাষ্ট্রকে চালকবিহীন বিমান থেকে হামলা চালানো বন্ধ করতে বলুন, না হলে এখানে আমরা শেষ হয়ে যাব, আর আফগানিস্তানে আপনারা ধ্বংস হয়ে যাবেন।’
হামিদ মির: পাকিস্তানি সাংবাদিক, জিয়ো টিভিতে কর্মরত।

No comments:

Post a Comment