Sunday, February 05, 2012

টেকনাফের প্রাচীন বৌদ্ধবিহার নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে

দখলদারদের থাবায় বিলুপ্ত হতে বসেছে কক্সবাজারের টেকনাফের প্রাচীন হ্নীলা বৌদ্ধবিহার (সেনপ্রু ক্যাং)।
প্রায় ২০০ বছর আগে জমিদার রাপুয়া চৌধুরী এই বিহারটি প্রতিষ্ঠা করেন।

সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ভাষাগত সংখ্যালঘু রাখাইন জনজাতির বৌদ্ধবিহারের ১১ একর জমি দখলের উদ্দেশ্যে সেখানে চালানো হয়েছে দফায় দফায় হামলা। দখলদার-সন্ত্রাসীরা কয়েক দফায় মন্দিরের দরজা-জানালা, আসবাবপত্র, কাঠের সিঁড়ি ও অবকাঠামো খুলে নিয়ে গেছে। চুরি হয়েছে মন্দিরের ২০টি প্রাচীন বুদ্ধ মূর্তির মধ্যে ১৮টিই। কোনো রকমে এখন টিকে আছে কয়েকটি নড়বড়ে খুঁটির ওপর মন্দিরের টিনের চালাটি। বিহার এলাকার বড় বড় গাছও কেটে ফেলেছে দখলদাররা। অরক্ষিত এলাকাটিতে রাখাইন জনজাতির লোকজন দিন-দুপুরেও যেতে ভয় পায়। উপরন্তু বিহারের জমিতে একে একে গড়ে উঠছে নতুন নতুন ঘর-বসতি।
রাখাইন নেতারা অভিযোগ করেছেন, আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মাদ আলী ২০০১ সালে নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে চুক্তি করে বিহারের প্রায় ১০ একর জমি ৯৯ বছরের জন্য ইজারা নেন। দেবোত্তর সম্পত্তি ইজারা দেওয়া বেআইনি বলে এক বছর পর ওই চুক্তি বাতিল করা হয়। কিন্তু দুই বছর ধরে বিহারের জমি দখলের চেষ্টার অংশ হিসেবে মোহাম্মাদ আলী ও তাঁর ছেলে রাশেদ মোহাম্মাদ আলী সদলবলে মন্দিরের সম্পদ লুঠপাট করে চলেছেন।
মোহাম্মাদ আলী এসব অভিযোগ স্বীকার করেননি। তিনি দাবি করে বলেন, প্রয়াত মন্দির পুরোহিত (ভান্তে) অধ্যক্ষ উপঞা বংশ মহাথেরোর কাছ থেকে বৈধভাবে বিহারের জমি ইজারা নিয়ে তিনি সেখানে ফলদ ও বনজ গাছের আবাদ করছেন। মন্দিরের সম্পদ লুটপাটের সঙ্গে তাঁদের কোনো সম্পর্ক নেই।
বাংলাদেশ রাখাইন-মারমা সংঘ কাউন্সিল চেয়াম্যান ভেন উ পণ্ডিত মহাথেরো অভিযোগ করে বলেন, মোহাম্মাদ আলী বিহারের জমি দখলের জন্য দফায় দফায় সেখানে লুঠতরাজসহ নানা সন্ত্রাসী হামলা চালাচ্ছেন। তিনি বলেন, নিরাপত্তার অভাবে সেখানে পুরোহিত দেওয়া যাচ্ছে না। সন্ত্রাসীরা কয়েক দফায় বিহারের তত্ত্বাবধায়ক ও নিরাপত্তা প্রহরীদের মারপিট করে সেখান থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে।
ভেন উ পণ্ডিত মহাথেরো জানান, প্রায় ২০০ বছর আগে জমিদার রাপুয়া চৌধুরী ওই বিহারটি প্রতিষ্ঠা করেন। এর প্রথম পুরোহিত বা ভান্তে ছিলেন উ কাওয়ানা মহাথেরো। বিভিন্ন সময় পাঁচজন ভান্তে সেখানে পর্যায়ক্রমে দায়িত্ব পালন করেন।
হ্নীলা বৌদ্ধবিহার রক্ষা কমিটির সদস্যসচিব ক্য জ' অং জানান, বিহার এলাকায় দুই বছর ধরে মাটির ঘরবাড়ি তুলে চার-পাঁচটি পরিবার বসতি গড়ে তুলেছে। তারা বিহারের জমিতে চাষবাসও করছে। তিনি বলেন, বিহারের জমি ও মন্দির রক্ষায় সেখানে একটি পুলিশ ফাঁড়ি প্রতিষ্ঠা করা না গেলে শিগগিরই প্রাচীন মন্দিরটি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। বিহারের জমিও পুরোপুরি বেদখল হয়ে যাবে।
স্থানীয় কৃষক মো. ইদ্রিস বলেন, সন্ত্রাসীদের ভয়ে রাখাইনরা এখন বিহার এলাকায় ঢুকতে ভয় পায়। আগে এখানে রাখাইন ছেলেমেয়েরা নিয়মিত লেখাপড়া করত। বিহারে নানা ধর্মীয় উৎসবও হতো।
রাখাইনপল্লী চৌধুরীপাড়ার বাসিন্দা ক্রং কেয়াং (৮২) বলেন, 'দুই বছর ধরে আমরা হ্নীলা বৌদ্ধবিহারে প্রার্থনা করতে আসতে পারি না। সন্ত্রাসীরা বিহারের মূর্তি চুরি করেই থেমে নেই, তারা এর দরোজা-জানালাও খুলে নিয়ে গেছে। তারা মন্দিরের খুঁটিগুলোও ভেঙে ফেলেছে।'
হ্নীলা বাজার এলাকার রাখাইন গৃহিণী নিমা (৫৫) বলেন, সন্ত্রাসীরা পাহারা বসিয়ে দিন-দুপুরে বিহার এলাকার পুরনো আম-কাঁঠাল গাছগুলোও কেটে নিয়ে গেছে। তাদের ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক জয়নুল বারী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'দেবোত্তর সম্পত্তি বিক্রি বা ইজারা দেওয়া সম্পূর্ণ বেআইনি। প্রাচীন হ্নীলা বৌদ্ধবিহারটি সন্ত্রাসীদের কবল থেকে উদ্ধার করে আমরা এটিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য সর্বাত্মক উদ্যোগ নেব। কোনো ক্রমেই ভাষা ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু রাখাইনদের বিহার এবং মন্দির বেহাত হতে দেওয়া যায় না।'
জেলা পুলিশ সুপার সেলিম মো. জাহাঙ্গীর জানান, এরই মধ্যে সহকারী পুলিশ সুপারের (উখিয়া সার্কেল) তদন্তে হ্নীলা বৌদ্ধবিহার দখলের নেপথ্যে একটি প্রভাবশালী মহলকে চিহ্নিত করা হয়েছে। রাখাইনরা আদালতে মামলা করলে পুলিশের পক্ষে বিহার ও মন্দিরের জমি দ্রুত পুনরুদ্ধারে সুবিধা হবে।
পুলিশ সুপার আরো বলেন, বিহারের জমি রক্ষায় রাতারাতি সেখানে পুলিশ ফাঁড়ি বসানো সম্ভব না হলেও টহল জোরদার করা হবে। তবে বিহারটি রক্ষায় রাখাইনদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।
এদিকে অভিযুক্ত আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মাদ আলী তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপিত সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, 'বিহারের ইজারাকৃত জমিতে আমার ছেলে (রাশেদ মোহাম্মাদ আলী) ৩২ হাজার ফলদ ও বনজ গাছ লাগিয়েছে। এখন প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণ পেলে আমি ইজারার দাবি ছেড়ে দেব। মন্দিরের টিলা নিয়ে আমি কি করব?' তিনি আরো বলেন, বিহার এলাকায় রাখাইন বসতি না থাকায় সেখানের মন্দিরের সম্পদ চুরি হচ্ছে। প্রয়াত মন্দির পুরোহিত বিহারের জমি বিক্রি করে সেখানে বাঙালি বসতি গড়ার অনুমতি দিয়েছেন। তাই এখন সেখানে ঘরবাড়ি উঠছে।

No comments:

Post a Comment