Thursday, December 30, 2010

সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণাঃ এরশাদ রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধ করেছেন

সামরিক শাসন জারির জন্য এরশাদ ষড়যন্ত্র ও রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধ করেছেন। এ বিষয়ে সাক্ষ্য ও প্রমাণ আছে কি না, সরকার তা খতিয়ে দেখবে। দণ্ডবিধির ১২২ ও ১২৪ ধারায় মামলা করার সাক্ষ্য আছে কি না, সরকার তা খতিয়ে দেখবে বলে আদালত প্রত্যাশা করে। ভবিষ্যতে যাতে কেউ এ ধরনের সামরিক শাসন জারির প্রচেষ্টা করতে না পারে, সে জন্য সামরিক শাসকদের বিচার হওয়া আবশ্যক। আর তাই নির্ভুল আইন প্রণয়ন হওয়া জরুরি।

আজ বুধবার সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে প্রকাশিত হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়ে এসব কথা বলা হয়। গত ২৬ আগস্ট সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। সেই সঙ্গে এরশাদের সামরিক শাসনকে সংবিধানপরিপন্থী ঘোষণা করা হয়। এ সংশোধনীতে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৮৬ সালের ১১ নভেম্বর পর্যন্ত সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলের বৈধতা দেওয়া হয়েছিল। বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বেঞ্চ এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে এ রায় দেন।
রায়ে আরও বলা হয়, পারভেজ মোশাররফদের ভাগ্যে কী আছে তা স্মরণ রাখা দরকার। দিনের শেষে কোনো সামরিক শাসকের ভাগ্যেই সুফল আসেনি।
এ ব্যাপারে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের নজির তুলে ধরে আদালত রায়ে বলেন, এরশাদসহ সামরিক অভিলাসীদের ক্ষমা করা হলেও তাঁদের ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে। যেসব বিচারপতি সামরিক শাসনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, তাঁরাও অসদাচরণের দায়ে শাস্তিযোগ্য অপরাধী হবেন।
যদিও এরশাদ প্রত্যক্ষ্যভাবে সংবিধানের কোনো স্তম্ভ ধ্বংস করেননি কিন্তু জিয়াউর রহমান সংবিধানের মূল স্তম্ভ ধ্বংস করেছিলেন। এর ধারাবাহিকতা বজায় রেখে এরশাদ সংবিধান ধ্বংসের অপরাধ করেছেন, যা রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধের শামিল।
এ ছাড়া এরশাদ জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও তাঁদের সাংবিধানিক অধিকার পদদলিত করে দীর্ঘ চার বছর সংবিধান স্থগিত রেখেছিলেন। ক্যাঙারু আদালতের মাধ্যমে বিচার চালিয়েছিলেন।
দেশে প্রথম সামরিক শাসনের দ্বার উন্মুক্ত করেন জেনারেল জিয়া ও মোশতাক। আন্তর্জাতিক ও দেশীয় রাজারকারদের চক্রান্তের ফলে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর সংবিধানের প্রতি বৃদ্ধাঙুলি দেখিয়ে জিয়া-মোশতাক চক্র সামরিক শাসন প্রচলন করে সংবিধানের ওপর প্রথম কুঠারাঘাত করেন। জিয়া শুধু সামরিক আইন প্রণয়ন করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি সংবিধানের দুটি মূল স্তম্ভ ধূলিসাত্ করে দিয়েছেন। একটি হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা ও অপরটি বাঙালি জাতীয়তাবাদ। সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ প্রবর্তন করেন তিনি।
‘জয় বাংলা’ স্লোগান ছিল স্বাধীনতা-উদ্দীপক স্লোগান। মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার স্লোগান পাল্টিয়ে পাকিস্তানি কায়দায় জিয়া ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ প্রবর্তন করেন। তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতিপূর্ণ রাজাকার শাহ আজিজুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। এ ছাড়া শীর্ষ রাজাকার কর্নেল মোস্তাফিজকে (আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচারক) পাকিস্তান থেকে এনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত করেন। বাংলাদেশবিরোধী বহু ব্যক্তিকে উচ্চমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেন।
এরশাদের শাসনামলে সামরিক আদালতের রায়ে সাজাপ্রাপ্ত চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সিদ্দিক আহমেদ হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ৫ এপ্রিল হাইকোর্ট রুল জারি করেন। সাবেক সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণ ও ১৯৮২ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত জারি করা সামরিক আইন, ফরমান, আদেশ ও নির্দেশকে বৈধতাদানকারী সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী কেন অবৈধ নয়, তা জানাতে চাওয়া হয়। রুলের ওপর সাত দিন শুনানি শেষে গত ২৬ আগস্ট আদালত রায় দেন।
ফিরে দেখা হত্যা মামলা ও সপ্তম সংশোধনী: ১৯৮৪ সালের ১২ নভেম্বর চট্টগ্রামের মসলা ব্যবসায়ী আবু তাহের খুন হন। ওই বছরের ২৪ ডিসেম্বর এ ঘটনায় চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানায় হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। সাধারণ আদালতে মামলাটি চলছিল। ১৯৮৬ সালের ১২ মার্চ এক আদেশে মামলাটি বিশেষ মার্শাল ল আদালত-৩ ( চট্টগ্রাম) স্থানান্তর করা হয়। ওই বছরের ২০ মার্চ আদালত সিদ্দিক আহমেদ, নূর মোহাম্মদ ও নুরুল আনোয়ারকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়ে রায় দেন। রায়ের সময় সিদ্দিক আহমেদ পলাতক ছিলেন। এরপর ২০০৬ সালের ২ আগস্ট তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এ বছরের ২৪ জানুয়ারি সামরিক শাসন জারি, সামরিক আদালতে বিচার ও দণ্ডের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিটটি দায়ের করেন সিদ্দিক আহমেদ। বর্তমানে তিনি জামিনে আছেন।
উল্লেখ্য, গত ২ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে দেওয়া হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের আবেদন খারিজ করেন আপিল বিভাগ। ২০০৫ সালের ২৯ আগস্ট দেওয়া হাইকোর্টের রায়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত খন্দকার মোশতাক আহমেদ, আবু সা’দাত মোহাম্মদ সায়েম ও জিয়াউর রহমানের শাসনকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়।

No comments:

Post a Comment