Monday, January 10, 2011

শাসকের কানে পৌঁছায় না ফেলানীর বাবার বিলাপ! by রাহীদ এজাজ

‘হামরা গরিব মানুষ, প্যাটের ভোকোত ভারত গেছিলাম, আর কোনো দিন যাবার নই। বাবা গো, তোমরা হামার বেটির লাশ আনি দেও, নিজ হাত মাটি দেমো।’ গত শনিবার এ কথাগুলো বলে বিলাপ করছিলেন নুরুল ইসলাম। মৃত্যুর দুই দিন পর সন্তানের লাশের মতো ভারী বোঝা কাঁধে নেওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার রামখানা ইউনিয়নের বানারভিটা গ্রামের এই হতদরিদ্র দিনমজুর।
নুরুলের বিলাপ শাসনযন্ত্রের কানে পৌঁছায় না। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় ৮ জানুয়ারি প্রকাশিত কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলন্ত মৃতদেহের ছবিও হূদয় স্পর্শ করে না! ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের তিন দিন পরও সরকার কোনো প্রতিবাদ করে না। কেন? গরিব বলে? আর কী বলেই বা বর্বরোচিত ওই হত্যাকাণ্ডের দায় এড়াবে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী? তারা কি বলবে, ১৫ বছরের ফেলানী দুষ্কৃতকারী, হামলা করেছিল বিএসএফের ওপর?
বছরের পর বছর বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে নির্বিচারে চলছে বিএসএফের হত্যাকাণ্ড। যদিও একতরফা হত্যাগুলোর পক্ষে সাফাই গেয়ে থাকে বিএসএফ। গত ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় বিডিআর-বিএসএফ সীমান্ত সম্মেলন শেষে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর প্রধান রমণ শ্রীবাস্তব বলেছিলেন, সীমান্তে প্রাণহানির যে ঘটনাগুলো ঘটছে তা ‘হত্যা’ বলা ঠিক হবে না। বলা উচিত ‘নিহত’ হচ্ছে। কারণ ‘হত্যা’ ও ‘নিহত’ দুটি শব্দের দ্যোতনা আলাদা। সীমান্তে প্রাণহানির যে ঘটনাগুলো ঘটছে, তার অধিকাংশই রাতের বেলা। ওই সময়ে সীমান্তে অনুপ্রবেশ করে তারা সীমান্ত আইন লঙ্ঘন করছে। ওই সময়ে যারা সীমান্ত পাড়ি দেয়, তাদের নিশ্চয়ই নিরপরাধ বলা যায় না। এ সময় সীমান্ত পেরিয়ে যারা ভারতে যায়, তারা অধিকাংশ সময় বিএসএফ সদস্যদের হামলা করে। আর আত্মরক্ষার জন্য বিএসএফকে গুলি ছুড়তে হয়। ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, নিরপরাধ বাংলাদেশি হত্যা বন্ধে ভারত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।
পত্রিকার খবরে জেনেছি, ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির উপকণ্ঠে একটি ইটভাটায় তিন ছেলে ও তিন মেয়েকে নিয়ে কাজ করত নুরুল ইসলামের পরিবার। গত শনিবার কুলাঘাট এলাকার একটি ছেলের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয় ফেলানীর। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উপার্জিত হাজার ত্রিশেক টাকা আর কিছু গয়না নিয়ে গত বুধবার দিল্লি থেকে দেশের পথ ধরেন বাবা আর মেয়ে। ওই দিন দালালের সহায়তায় বেশ কয়েকবার পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত পাড়ি দিতে ব্যর্থ হন বাবা-মেয়ে। শুক্রবার ভোরে মই দিয়ে কাঁটাতারের বেড়া পেরোন নুরুল। কিন্তু কাঁটাতারে কাপড় আটকে যায় মেয়ে ফেলানীর। ভয়ে চিৎকার করে ওঠে সে। শেষ পৌষের কনকনে শীতের ভোরে কিশোরীর আর্তচিৎকার থামিয়ে দেয় বিএসএফের নির্দয় বুলেট। হত্যার কয়েক ঘণ্টা পরও বিএসএফ লাশটি ঝুলিয়ে রাখে।
প্রশ্ন হচ্ছে, আর কত লাশ পড়লে বন্ধ হবে বিএসএফের হত্যাযজ্ঞ? প্রতিবছর বিভিন্ন পর্যায়ের বৈঠকে হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে বাংলাদেশ উদ্বেগ জানালে ভারত হত্যা বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। অব্যাহতভাবে চলছে এ হত্যাকাণ্ড।
মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিএসএফ ২০১০ সালে ৭৪ জন নিরপরাধ ও নিরস্ত্র বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে। ২০০৯, ২০০৮ ও ২০০৭ সালে এ সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৯৬, ৬২ ও ১২০।
প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও বাংলাদেশি হত্যা বন্ধে ভারতের আন্তরিকতা প্রশ্নবিদ্ধ। আর নিরপরাধ লোকজনের হত্যা রোধে বাংলাদেশ সরকারের পদক্ষেপও যথেষ্ট নয়। বিশেষ করে ফেলানীর মৃত্যুর ৪৮ ঘণ্টা পরও পররাষ্ট্র কিংবা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সক্রিয় হতে দেখা যায়নি। এ অবস্থায় আমরা আর কত ফেলানীর স্বপ্ন চুরমার হওয়ার দর্শক হয়ে থাকব?

No comments:

Post a Comment