Monday, October 01, 2012

বৌদ্ধ মন্দির ও বাড়িতে আগুন

কক্সবাজারের রামু উপজেলায় পবিত্র কোরআন অবমাননার অভিযোগে বিক্ষুব্ধ জনতা শনিবার রাতে মিছিল করে ১১টি বৌদ্ধ মন্দির ও ১৫টি বাড়িতে আগুন দিয়েছে। বড়ূয়া পরিবারের ৩০টি বসতবাড়ি ভাংচুর ও লুটপাট করেছে।

পরিস্থিতি সামলাতে রামুতে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। জোরদার করা হয়েছে নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এ ঘটনার জের ধরে উখিয়া ও পটিয়ায় বৌদ্ধ মন্দিরে অগি্নসংযোগ করা হয়েছে। রামুর ঘটনা তদন্তে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বান্দরবান ও রাঙামাটিতে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে সতর্ক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। দুটি শহরে পুলিশ টহল দিচ্ছে। নিউইয়র্কে অবস্থানরত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘটনা অবহিত হয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া রামুর ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে এ ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করেছেন। এ দুঃখজনক ঘটনার পর গতকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর রামু পরিদর্শনে যান। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এ ঘটনা মৌলবাদী গোষ্ঠীর পরিকল্পিত হামলা। এর সঙ্গে স্থানীয় বিএনপি এমপি জড়িত বলে তিনি দাবি করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ূয়া ছিলেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ঘটনার তীব্র নিন্দা করে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। ঢাকা ও চট্টগ্রামে এই ন্যক্কারজনক ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে সমাবেশ হয়েছে। সন্ধ্যা ৭টায় উখিয়া ও টেকনাফে বৌদ্ধ মন্দির ও বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। ঢাকাসহ সারাদেশের বৌদ্ধবিহারের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
কক্সবাজারের রামু উপজেলা সদরে শনিবার রাতে বিক্ষুব্ধ জনতা বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের শত বছরের পুরনো ১১টি বৌদ্ধবিহার এবং ১৫টি বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া ২টি বৌদ্ধবিহারসহ অন্তত ৩০টি ঘরবাড়ি ভাংচুর করা হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে রোববার সকাল থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য রামু উপজেলা সদরে ১৪৪ ধারা জারি করে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। ওই এলাকায় বিজিবি, র‌্যাব ও পুলিশ সদস্যরা টহল দিচ্ছে।
পুলিশ এবং প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে, রামু উপজেলার ফতেখাঁরকুল ইউনিয়নের চেরাংঘাটা এলাকার উত্তম কুমার বড়ূয়া নামে এক যুবকের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট ফেসবুকে পবিত্র কোরআন অবমাননা করে একটি ছবি সংযুক্ত করার অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় বিক্ষুব্ধ জনতা শনিবার রাত সাড়ে ১০টায় উপজেলা সদরে মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করে। রাত সাড়ে ১২টার দিকে উত্তেজিত জনতা প্রথমে চৌমুহনী-চেরাংঘাটা সড়কে শ্রীকুল লাল চিং ও সাধনা ধ্বজ বৌদ্ধবিহারে (সাদা চিং) অগি্নসংযোগ করে। পরে ভোর রাত পর্যন্ত একে একে ১১টি বৌদ্ধ মন্দিরে আগুন দেওয়া হয়। ভাংচুর করা হয় আরও ২টি বৌদ্ধ মন্দির। পুড়ে যাওয়া মন্দিরগুলো হচ্ছে পশ্চিম মেরংলোয়া গ্রামের কেন্দ্রীয় সীমা বিহার, উত্তর শ্রীকুল গ্রামের সাদা চিং ও লাল চিং, মৈত্রী বিহার, অপর্ণাচরণ বৌদ্ধবিহার, উত্তর মিঠাছড়ি গ্রামের প্রজ্ঞামিত্র বনবিহার, সীমাঘর, লাল চিং, বিমুক্তি ভাবনা বিদর্শন কেন্দ্র, উখিয়ারঘোনা গ্রামের তেজবন বিহার ও লট উখিয়ারঘোনা গ্রামের আর্য বংশ বৌদ্ধবিহার। ভাংচুর করা হয়েছে চেরাংঘাটা বড় ক্যাং ও উত্তর ফতেখাঁরকুল গ্রামের বিবেকারাম বৌদ্ধবিহার।
ক্ষতিগ্রস্তরা জানিয়েছে, রামু সদরের বড়ূয়াপাড়া ও পাশের শ্রীকুল বড়ূয়াপাড়ায় অন্তত ১৫টি ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ভাংচুর করা হয়েছে আরও ৩০টি ঘরবাড়ি। এ সময় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজন ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে রক্ষা পায়। পুলিশ অসহায়ের মতো ঘটনা প্রত্যক্ষ করে। রাত দেড়টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের একটি গাড়ি ঘটনাস্থলে গেলেও বিক্ষুব্ধ জনতার প্রতিরোধের মুখে ঘটনাস্থল ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। পরে জেলা সদর থেকে অতিরিক্ত দাঙ্গা পুলিশ, বিজিবি এবং র‌্যাব মাঠে নামানো হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। এ সময় দমকল বাহিনী আগুন নেভানোর চেষ্টা চালায়। তবে তার আগেই ১১টি বৌদ্ধবিহার ও ১৫টি বসতবাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
রামু উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সোহেল সরওয়ার কাজল জানান, উত্তেজনার খবর পেয়েই তিনি ঘটনাস্থলে গেছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করেও প্রাচীন বৌদ্ধবিহারগুলো রক্ষা করতে পারেনি। বুদ্ধমূর্তিসহ মূল্যবান অনেক সম্পদ পুড়ে গেছে বলে তিনি জানান। সোহেল সরওয়ার কাজল জানান, পবিত্র কোরআন অবমাননার বিষয়টি দুঃখজনক। সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করার উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে ঘরবাড়িতে হামলা ও আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। রামু-কক্সবাজার আসনের সংসদ সদস্য লুৎফুর রহমান কাজল রাতে ঘটনাস্থলে গিয়ে উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করার চেষ্টা চালান।
অভিযুক্ত উত্তম কুমার বড়ূয়া দাবি করেছেন, অন্য কেউ ফেসবুকে ওই ছবিটি ট্যাগ করে দিয়েছে। বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর ফেসবুক অ্যাকাউন্টটি তিনি বন্ধ করে দিয়েছেন। পুলিশ উত্তম কুমার বড়ূয়া ও তার পরিবারকে নিরাপত্তা হেফাজতে নিয়েছে।
এদিকে ক্ষতিগ্রস্ত বড়ূয়া সম্প্রদায়ের লোকজন ভাংচুর ও অগি্নসংযোগের ঘটনায় পুলিশ প্রশাসনের অবহেলাকে দায়ী করেছে। তাদের দাবি, সময়মতো পদক্ষেপ নেওয়া হলে উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করা সম্ভব হতো। ক্ষতিগ্রস্ত বৌদ্ধ নারী-পুরুষদের অভিযোগ, শনিবার সন্ধ্যার পর থেকে উত্তেজিত জনতা বৌদ্ধপল্লীতে মিছিল-সমাবেশ করলেও পুলিশসহ অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা ছিল নিষ্ক্রিয়। ফলে উচ্ছৃঙ্খল জনতা বেপরোয়া হয়ে হামলা, ভাংচুর ও অগি্নসংযোগ করার সুযোগ পেয়েছে। পুলিশ সুপার সেলিম মো. জাহাঙ্গীর জানিয়েছেন, রামুর পরিস্থিতি এখন থমথমে। সহিংসতা এড়াতে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে।
উখিয়া (কক্সবাজার) সংবাদদাতা জানান, রামুর ঘটনার জের ধরে উখিয়ায় উত্তেজিত জনতা বৌদ্ধ মন্দিরে হামলা চালিয়ে বুদ্ধমূর্তি ভাংচুর করে। এ সময় উপাসনারত বৌদ্ধ ভিক্ষুরা মন্দির ছেড়ে পালিয়ে যায়। খবর পেয়ে উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনলেও রাতে আবার হামলার চেষ্টা চলে। এ ঘটনার পর র‌্যাব, পুলিশ, বিজিবির টহল জোরদারসহ ৩২টি বৌদ্ধ মন্দিরে সশস্ত্র পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে বলে উখিয়া থানার ওসি অপ্পেলা রাজু নাহা জানিয়েছেন।
জানা যায়, গতকাল রোববার সকাল ১০টায় রামু উপজেলার খুনিয়াপালং ইউনিয়নে একটি বিশাল বিক্ষোভ মিছিল উখিয়ায় আসার চেষ্টাকালে উপজেলা প্রশাসন পুলিশের সহায়তায় ওই মিছিল থামিয়ে দেয়। দুপুর ২টায় কোটবাজার এলাকায় উত্তেজিত জনতা একটি মিছিল বের করলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনে সংক্ষিপ্ত পথসভায় উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী সর্বসাধারণকে ধৈর্য ধারণ করে শান্ত থাকার অনুরোধ জানান। ওই সময় সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মাহমুদুল হক চৌধুরী ও হলদিয়াপালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন মিন্টু বিক্ষোভ মিছিলউত্তর পথসভায় পবিত্র কোরআন অবমাননাকারীকে ৩ দিনের মধ্যে গ্রেফতার করা না হলে কঠোর আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলে হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন।
বিকেল সাড়ে ৪টায় একটি বিক্ষোভ মিছিল উখিয়া রাজাপালং ইউনিয়নের জাদিমোরা এলাকায় পেঁৗছলে উত্তেজিত জনতা বৌদ্ধ মন্দিরে হামলা চালিয়ে ৩-৪টি বুদ্ধমূর্তি ভাংচুর করে। এ সময় বৌদ্ধ মন্দিরে উপাসনার কাজে নিয়োজিত ভিক্ষুরা প্রাণভয়ে পালিয়ে যায়। বৌদ্ধ মন্দির পরিচালনা কমিটির সভাপতি অরুণ বড়ূয়া অভিযোগ করে বলেন, স্থানীয় বিক্ষোভকারী জনতা মন্দিরে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে ৩-৪টি বুদ্ধ ও অন্যান্য মূর্তি ভাংচুর করে। খবর পেয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট শাহজালাল চৌধুরী, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জহিরুল ইসলাম পুলিশ বাহিনী নিয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে উত্তেজিত জনতা মন্দির ছেড়ে পালিয়ে যায়। ইউএনও মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, সাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী এ দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার জন্য পরিকল্পিতভাবে ফেসবুকের মাধ্যমে এ ন্যক্কারজনক ঘটনাটি ঘটিয়েছে। তিনি বলেন, পরিস্থিতি শান্ত রাখার জন্য সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
এদিকে গতকাল সন্ধ্যা ৭টায় উত্তেজিত জনতা রুমখা পালং ও পূর্ব রত্না বৌদ্ধ মন্দিরে অগি্নসংযোগের চেষ্টা করলে পুলিশ বাধা দেয়। এ সময় পুলিশ ও জনতার মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার একপর্যায়ে পুলিশ গুলি ছোড়ে। উত্তেজিত জনতা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। পরে বিজিবি ও র‌্যাব ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। ঘটনাস্থলে পুলিশসহ অর্ধশতাধিক আহত হয়।
পুলিশের হাবিলদার শফিক আহমদ জানান, ঘটনাস্থলে উখিয়া পুলিশের এসআই আনোয়ারুল্লাহ (৪৫), কনস্টেবল উমং মারমা (৩৫), সাইদুর রহমান (৪০), তাজুল ইসলামসহ (৪৫) পাঁচ পুলিশ আহত হয়। এ সময় পুলিশ আত্মরক্ষার্থে এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে। রত্নাপালং ইউপি সদস্য আকতার কামাল চৌং জানান, উত্তর পুকুরিয়া গ্রামের মো. রুবেল (২০), আবদু শুক্কুরসহ (২১) অর্ধশতাধিক লোক আহত হয়েছে। আহতদের উখিয়া সদর হাসপাতাল ও কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। র‌্যাব-৭-এর ডিএডি জাহাঙ্গীর ও রহমান বিকেলে জানান, বিভিন্ন গ্রাম থেকে আসা লোকজন রাস্তার মোড়ে মোড়ে অবস্থান নেয়। বৌদ্ধ মন্দিরে হামলাসহ যে কোনো নাশকতা মোকাবেলায় র‌্যাব প্রস্তুত রয়েছে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য শতাধিক পুলিশ-বিজিবি ও র‌্যাব সদস্যকে বিভিন্ন বৌদ্ধ মন্দিরে পাঠানো হয়েছে। রাত ৯টার দিকে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার পুলিশ ফোর্স নিয়ে ঘটনাস্থলে ছিলেন।
টেকনাফ থেকে স্থানীয় লোকজন, পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে, সন্ধ্যায় টেকনাফের হোয়াইক্যং লম্বাবিল এলাকা থেকে একটি মিছিল বের করে হোয়াইক্যং বড়ূয়া অধ্যুষিত এলাকা লাতুরীখোলা নামক গ্রামের দিকে যেতে থাকে। মিছিলটি ওই এলাকায় পেঁৗছলে বিপুল লোক সমবেত হয়। বড়ূয়া ও হিন্দুপাড়ায় গিয়ে লোকজন একটি বড়ূয়া ও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের চারটি বসতবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। খবর পেয়ে হোয়াইক্যং পুলিশ ফাঁড়ির আইসি এসআই বখতিয়ারের নেতৃত্বে একদল পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে চেষ্টা করে। এতে লোকজন আরও মারমুখী হয়ে উঠলে পুলিশ প্রায় ১৫ রাউন্ড গুলি ছোড়ে। এতে আমতলীর আবুল কাশেমের ছেলে মো. জাহেদ (১৮), লম্বাবিলের মিয়ার ছেলে মো. জালাল (১৬), স্থানীয় জসিম উদ্দিনের ছেলে মো. করিম (১৮), আবদুল হাকিমের ছেলে মোস্তাক (২৫), মো. আলমের শিশুপুত্র পুতিয়া (৮), নুরুল আলমের ছেলে মো. হোছন (১৮), নুরুল ইসলামের ছেলে হাছান আলীসহ (১৮) ছয়-সাতজন গুলিবিদ্ধ হয়।
এ ছাড়া হোয়াইক্যং ইউপি চেয়ারম্যান ও জেলা জামায়াতের রোকন নূর আহমদ আনোয়ারী, ৩ পুলিশ কনস্টেবল, সংবাদকর্মী রমজান উদ্দিন পটলসহ ২০ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এ খবর হোয়াইক্যং স্টেশনে পেঁৗছলে উত্তেজিত লোকজন টায়ার জ্বালিয়ে টেকনাফ-কক্সবাজার সড়কে ব্যারিকেড দেয়। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত (রাত ৯টা) তুমুল উত্তেজনা বিরাজ করছিল।
টেকনাফ থানার ওসি মোহাম্মদ ফরহাদ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, খবর পেয়ে স্থানীয় চেয়ারম্যানসহ পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। এতে সংঘর্ষ বাধে। এখন পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কক্সবাজার সদর হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, এ ঘটনায় আহত উখিয়ার পুলিশ সদস্য আনোয়ার (৪৫), উখিয়ার শাহাব উদ্দিন (২৭) ও নুর মোহাম্মদকে (২৩) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপার সেলিম মো. জাহাঙ্গীর ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, ঘটনাস্থলে পুলিশ রয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে।
পটিয়া (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, ফেসবুকে কোরআন অবমাননার অভিযোগে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার কোলাগাঁও ইউনিয়নের লাখেরা অভয় বিহার (বৌদ্ধ বিহার), কোলাগাঁও দুর্গাবাড়িসহ পাঁচটি মন্দিরে হামলা, ভাংচুর ও অগি্নসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। গতকাল রোববার দুপুর ১২টায় এ ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কোলাগাঁওয়ে শিপইয়ার্ডের শ্রমিকরা ওই হামলা চালায়। এ সময় উচ্ছৃঙ্খল শ্রমিকরা রড, লাঠিসোটা নিয়ে প্রথমে লালপুল এলাকায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে লাখেরা বড়ূয়াপাড়া দিয়ে ঢুকে কয়েকটি ছোট মন্দির ও দোকান ভাংচুরের পর লাখেরা বৌদ্ধবিহারে ব্যাপক ভাংচুর চালায়। এ সময় বাধা দিতে গেলে বৌদ্ধবিহারে দায়িত্বরত চার পুলিশ সদস্য আহত হলেও মন্দিরের কেউ আহত হননি। পরে শ্রমিকরা ফিরে যাওয়ার পথে কোলাগাঁও দুর্গাবাড়ি ও কোলাগাঁও বৌদ্ধবিহারে হামলা চালায় ও অগি্নসংযোগ করে। বর্তমানে ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ ও র‌্যাব মোতায়েন রয়েছে।
লাখেরা বৌদ্ধবিহার সমিতির সাধারণ সম্পাদক শিমুল বড়ূয়া জানান, ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের ৪০০ থেকে ৫০০ শ্রমিক বৌদ্ধ মন্দিরে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাংচুর ও লুটপাট চালায়। তারা অনেক মূর্তি ভাংচুর করেছে। কোলাগাঁও দুর্গাবাড়ির নবারুণ সংঘের সাধারণ সম্পাদক বিপ্লব চৌধুরী জানান, শ্রমিকরা দুর্গাবাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাংচুর, অগি্নসংযোগ ও লুটপাট করে।
এদিকে ঘটনার পরপর পটিয়ার এমপি সামশুল হক চৌধুরী, চট্টগ্রামের ডিআইজি, পটিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (চট্টগ্রাম দক্ষিণ), র‌্যাব-৭-এর কোম্পানি কমান্ডার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রোকেয়া পারভীন জানান, ওয়েস্টার্ন মেরিন কারখানার সিসি ক্যামেরা পরীক্ষা করে যারা ঘটনায় গিয়েছিল তাদের নাম-ঠিকানা নেওয়ার পর দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে ওয়েস্টার্ন মেরিন কর্তৃপক্ষ দোষীদের বিচারসহ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে।
রাঙামাটি অফিস জানায়, কক্সবাজারের রামুতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা ও বৌদ্ধবিহারসহ বাড়িঘরে অগি্নসংযোগের প্রতিবাদে গতকাল রোববার রাঙামাটির কুতুকছড়িতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ।
ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট সমর্থিত সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের জেলা শাখার দফতর সম্পাদক তাপুমণি চাকমা স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিক্ষোভ মিছিলটি বড় মহাপুরম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে থেকে শুরু হয়ে কুতুকছড়ি বাজার প্রদক্ষিণ শেষে বিদ্যালয় ফটকের সামনে শেষ হয়। পরে সেখানে প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের রাঙামাটি জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক বাবুল চাকমা প্রমুখ।
বান্দরবান প্রতিনিধি জানান, রামুর ঘটনায় পার্শ্ববর্তী এলাকা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি, লামা, আলীকদমে আতঙ্ক ও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বড় ধরনের কোনো ঘটনা যাতে না ঘটে তার জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সতর্ক অবস্থায় থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বান্দরবান জেলায় পরিস্থিতি শান্ত রাখতে গতকাল রোববার দুপুরে জেলা প্রশাসক সভাকক্ষে তাৎক্ষণিকভাবে এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। মতবিনিময় সভায় ইউনিয়ন ও উপজেলাগুলোতে ব্যাপক নিরাপত্তা জোরদারসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
বড় ধরনের কোনো ঘটনা এড়াতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশ ও বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) কড়া নিরাপত্তা জোরদার করে। গত শনিবার রাত ২টার দিকে কিছু উত্তেজিত জনতা বাসে করে গর্জনিয়া থেকে রামুর দিকে যাওয়ার পথে পুলিশ ৩৪ জনকে আটক করেছে। কী উদ্দেশে তারা একসঙ্গে এতজন রামুর দিকে যাচ্ছিল তার সঠিক উত্তর দিতে পারেনি বলে পুলিশ জানিয়েছে। তবে ধারণা করা হচ্ছে, এত রাতে আটককৃতরা সহিংসতায় অংশ নিতে যাচ্ছিল।
ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনার নির্দেশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর
কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধ বসতিতে হামলা, ভাংচুর ও অগি্নসংযোগের ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার নির্দেশ দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর। গতকাল রোববার দুপুর ২টায় মন্ত্রী রামুতে পেঁৗছে ক্ষতিগ্রস্ত বৌদ্ধ মন্দির ও ঘরবাড়ি পরিদর্শন করেন। এ সময় বৌদ্ধধর্মের লোকজনের সঙ্গে আলাপ করেন তিনি। পরিদর্শন শেষে তিনি বলেন, একটি মহল বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার পাঁয়তারা করছে। এটি তারই অংশবিশেষ। অপরাধী যেই হোক তাকে শনাক্ত করে শাস্তির নির্দেশ দেন মন্ত্রী।
রোববার দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ূয়া, পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার, র‌্যাবের মহাপরিচালক মোখলেছুর রহমান, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার সিরাজুল হক খান, চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি নওশের আলী, কক্সবাজারের জেলা পরিষদ প্রশাসক মোস্তাক আহমদ চৌধুরীসহ পুলিশের পদস্থ কর্মকর্তারা।
পরিদর্শন শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এ দেশে সব সম্প্রদায়ের ধর্ম পালনের অধিকার রয়েছে। পাশাপাশি ধর্মীয় মর্যাদা রক্ষা করাও সব সম্প্রদায়ের লোকদের দায়িত্ব। রামুর ঘটনায় পুলিশের ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, কিছু উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তি দ্বারা সংঘটিত বৌদ্ধবিহার ও বসতঘর পোড়ানোর ঘটনায় পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে অনেক অভিযোগ পেয়েছি। এসব অভিযোগ যথাযথভাবে তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পুরো বিষয়টি তদন্ত করে দেখতে তিনি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন।
শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ূয়া বলেন, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সমৃদ্ধ এ দেশের সম্মানকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিনষ্ট করতে কিছু স্বার্থান্বেষী ও উচ্ছৃঙ্খল মহল উঠেপড়ে লেগেছে। মুক্তিযুদ্ধের অর্জিত এ সম্মানকে ভূলুণ্ঠিত হতে দেওয়া যাবে না। এ ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

No comments:

Post a Comment