Monday, October 01, 2012

রামু, উখিয়া ও পটিয়ায় বৌদ্ধ বসতিতে হামলা অগ্নিসংযোগ, সেনা মোতায়েন

কক্সবাজারের রামু, উখিয়া ও চট্টগ্রামের পটিয়ায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের বসতি, মন্দির ও বিহারে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। শনিবার রাত থেকে গতকাল পর্যন্ত এ হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।

এতে রামু উপজেলার ১১টি বৌদ্ধ মন্দির ভাঙচুর, প্রায় ২০টি বাড়ি ও দোকান পুড়িয়ে দেয় হামলাকারীরা। হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয় আরও অর্ধশতাধিক বাড়ি ও দোকানে। ঘটনার পর থেকে এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। গতকাল সকাল থেকে রামুতে অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করেছে স্থানীয় প্রশাসন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ওই এলাকায় সেনা, বিজিবি ও পুলিশের যৌথ টহল জোরদার করা হয়েছে। গতকাল সকালে ওই এলাকা পরিদর্শন করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করে শাস্তি দেয়া হবে। এদিকে এ ঘটনায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের পক্ষ থেকে নিন্দা জানানো হয়েছে। ফেসবুকে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অবমাননাকর ছবি দেয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে শনিবার বিকাল থেকে ওই এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয়দের অভিযোগ, এক বৌদ্ধ যুবক মহানবী (সা.)-এর অবমাননাকর ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে।
গতকাল দুপুরের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রামুর আক্রান্ত বিভিন্ন মন্দির ও ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন শেষে রামু চৌমুহনীতে এক পথসভায় তিনি বৌদ্ধ বসতিতে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে অবিলম্বে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেন। পথসভায় শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়াও বক্তব্য রাখেন। ওই সময় প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ বিশিষ্টজনরা উপস্থিত ছিলেন। পরে মন্ত্রীদ্বয় জেলা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অবমাননা করে উত্তম কুমার বড়ুয়া নামের এক বৌদ্ধ যুবক ফেসবুকে একটি ছবি পোস্ট করে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে শনিবার দিনভর ওই এলাকায় মুসলমানদের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করে। বিভিন্ন মসজিদ থেকে বের হয়ে মুসল্লিরা মিছিল ও বিক্ষোভ করেন। রাত ১০টায় কয়েক শ’ মানুষ চৌমুহনীতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে। মিছিল-উত্তর সমাবেশে বক্তারা উত্তম কুমার বড়ুয়ার শাস্তির দাবি জানান। এ সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রামু পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে উত্তেজিত মানুষ তাদের ওপর চড়াও হয়। সমাবেশ শেষ হওয়ার কিছু পর ফের একটি মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি রাত সাড়ে ১১টার দিকে রামু বড়ুয়াপাড়ার দিকে এগিয়ে যায়। সেখানে কয়েকজন যুবক বড়ুয়াদের কয়েকটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। পরে এ সংঘাত বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। রাত সাড়ে ১২টার দিকে ক্ষুব্ধ জনতা রামুর চেরাংঘাটা সড়কের ৩০০ বছরের পুরনো মৈত্রী বিহারে আগুন ধরিয়ে দেয়। এরপর বড়ক্যাং বৌদ্ধ বিহার ও কেন্দ্রীয় সীমা বিহারসহ ১২টি বিহারে অগ্নিসংযোগ করা হয়। রাত তিনটা পর্যন্ত এসব বিহার দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে। এ সময় বৌদ্ধ মূর্তিসহ মূল্যবান সমপদ পুড়ে যায়। এছাড়া রামুর শ্রীকুলের বড়ুয়াপাড়া বৌদ্ধ বিহারে ভাঙচুর চালায় ক্ষুব্ধ জনতা। ওই সময় উত্তেজিত জনতা অর্ধশতাধিক বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এতে সংখ্যালঘু বৌদ্ধ সমপ্রদায়ের লোকজনের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আতঙ্কিত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়। খবর পেয়ে কক্সবাজার-রামু আসনের এমপি লুৎফুর রহমান কাজল, পুলিশ সুপার সেলিম মো. জাহাঙ্গীর, রামু উপজেলা চেয়ারম্যান সোহেল সরওয়ার কাজলসহ জনপ্রতিনিধি, প্রশাসনিক কর্মকর্তা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। জনপ্রতিনিধিরা উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করতে ব্যর্থ হলে পুলিশ কঠোর অবস্থানে যায়। স্থানীয়রা জানান, উত্তেজনা চলাকালে রাতে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। উত্তেজিত লোকজন রামুর সাদা চিং, লাল চিং, রামু মেত্রী বিহার, সীনা বিহার, জাদীপাড়া বৌদ্ধবিহার, বিমুক্তি বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্র, মিঠাছড়ি বনবিহারে হামলা করে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। এক পর্যায়ে তারা ওইসব মন্দির ও গির্জায় অগ্নিসংযোগ করে। এছাড়াও রামুর চৌমুহনী-চেরাংঘাটা সড়ক, মিঠাছড়ি, বড়ুয়াপাড়ার কিছু বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। কক্সবাজার থেকে রাত একটায় দমকল বাহিনীর গাড়ি রামুতে যায়। কিন্তু নিরাপত্তার অভাবে তারা প্রথমে কাজ করতে ব্যর্থ হয়। পরে রাত আড়াইটায় পুলিশের সহযোগিতায় দমকল বাহিনী আগুন নেভানোর চেষ্টা করে। এর আগেই বৌদ্ধ বিহারসহ অসংখ্য ঘর পুড়ে যায়। অপরদিকে রামু থানার পুলিশ উত্তম কুমার বড়ুয়া ও তার মাকে নিরাপত্তা হেফাজতে নিয়ে রেখেছে বলে জানা গেছে। কক্সবাজারের পুলিশ সুপার সেলিম মো. জাহাঙ্গীর জানিয়েছেন, রামুর বিভিন্ন এলাকায় বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। পরিস্থিতি এখন অনেকটা শান্ত ও পুলিশের নিয়ন্ত্রণে।
উখিয়া-টেকনাফেও সহিংসতা: সহিংস ঘটনা রামু উপজেলার পার্শ্ববর্তী উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলাতেও ছড়িয়ে পড়েছে। গতকাল সন্ধ্যা ৭টায় উখিয়া উপজেলার রাজাপালং জাদি মুরা বৌদ্ধ বিহার ও কোটবাজার বৌদ্ধ বিহারে হামলার ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া রত্নাপালং ইউনিয়নের রুমখা বড়বিল এলাকায় মিছিলের প্রস্তুতি নেয়ার সময় পুলিশ বাধা দেয়। এতে উভয় পক্ষে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। এ সময় পুলিশের এসআই আনোয়ার উলাহ, রুমখা এলাকার বশির আহমদের পুত্র গিয়াস উদ্দিনসহ (৩০) প্রায় ১০ জন আহত হয়। তাদের উখিয়া স্বাস্থ্য কমপেক্স ও কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ ঘটনায় পুরো এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে। উখিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) নিলু কান্তি বড়ুয়া এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। অপরদিকে টেকনাফের হোয়াইক্ষ্যংয়ের আমতলী বৌদ্ধ বিহারে হামলা করেছে উত্তেজিত জনতা। এ ঘটনায় পুলিশ বাধা দেয়ার চেষ্টা করলে তাদের ওপর চড়াও হয় তারা। পুলিশ বাধ্য হয়ে গুলি ছোড়ে। এতে স্থানীয় চেয়ারম্যান নুর আহমদ আনোয়ারীসহ ৪ জন গুলিবিদ্ধ হন। বর্তমানে ওই এলাকায় বিপুল সংখ্যক বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
পটিয়ায় বৌদ্ধ বিহার মন্দিরে হামলা
স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম থেকে জানান, চট্টগ্রামের পটিয়াতে বৌদ্ধ বিহার ও হিন্দু মন্দিরে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। সেখানকার কোলাগাঁও ইউনিয়নের লাখেরা বৌদ্ধ বিহার, কোলাগাঁও দুর্গাবাড়িসহ কয়েকটি বৌদ্ধ বিহার ও হিন্দু মন্দিরে হামলা চালিয়েছে শিপইয়ার্ডের শ্রমিকরা। গতকাল দুপুরে শ্রমিকরা এ ঘটনা ঘটায়। স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শী ও গ্রামবাসীর অভিযোগ, পার্শ্ববর্তী একটি শিপ ইয়ার্ডের ৪০০-৫০০ শ্রমিক এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত। সমপ্রতি মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরান শরীফ নিয়ে অবমাননাকর চিত্র ফেসবুকে স্থান পায়। আর এ কারণে কোলাগাঁওয়ের স্থানীয় একটি বৃহৎ জাহাজ নির্মাণকারী শিপ ইয়ার্ডের শ্রমিকরা গতকাল ক্ষুব্ধ হয়ে লালপুল এলাকায় যায়। তারা লোহার রড, লাঠিসোটা নিয়ে প্রথমে লাখেরা বড়ুয়াপাড়া দিয়ে ঢোকে। তারপর সামনের কয়েকটি ছোট মন্দির ও দোকানপাট ভাঙচুর করে। এরপর লাখেরা বৌদ্ধ বিহারে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। পরে শ্রমিকরা ফিরে যাওয়ার পথে কোলাগাঁও দুর্গাবাড়ি ও কোলাগাঁও বৌদ্ধ বিহারে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে। ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ ও র‌্যাব মোতায়েন রয়েছে। লাখেরা অভয় বিহার অধ্যক্ষ ধর্মানন্দ থেরো জানান, ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপ ইয়ার্ডের ৪-৫শ’ উচ্ছৃঙ্খল শ্রমিক বৌদ্ধ মন্দির হামলা চালিয়ে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে লুটপাট করেছে। তারা বড় বড় মূর্তিসহ অনেক মূর্তি ভাঙচুর করেছে।


এদিকে ঘটনার পর পর পটিয়ার এমপি সামশুল হক চৌধুরী, চট্টগ্রামের ডিআইজি, উপজেলা চেয়ারম্যান ইদ্রিস মিয়া, পটিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রোকেয়া পারভীন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (চট্টগ্রাম দক্ষিণ) নাজমুল আহসান, র‌্যাব- ৭ এর কোম্পানি কমান্ডার এএসপি সাখাওয়াত হোসেন, পটিয়া সার্কেল এএসপি নজরুল ইসলাম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রোকেয়া পারভীন বলেন, ওয়েস্টার্ন মেরিনের কারখানার সিসি ক্যামেরা ব্যবহার করে হামলায় জড়িতদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে।


বাড়তি সতর্কতা
বৌদ্ধ বিহার ও হিন্দু মন্দিরে যাতে কোন ধরনের সংঘাত ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেজন্য চট্টগ্রাম নগরীতে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। নেয়া হয়েছে পুলিশি ব্যবস্থা। শহরজুড়ে গতকাল সন্ধ্যার পর থেকে মোড়ে মোড়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজনকে টহল দিতে দেখা যায়। বিশেষ করে বৌদ্ধ মন্দিরগুলোর আশপাশে নানা পোশাকে ডিবির লোকজন মোতায়েন করা হয়েছে বলে পুলিশের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছেন।
নগর পুলিশের দু’টি সূত্র জানায়, গতকাল দুপুর থেকে চট্টগ্রাম নগরীর অন্যতম বৌদ্ধবিহার নন্দনকানন ছাড়াও শহরের হেমসেন লেইন, চেরাগীপাহাড়, মোগলটুলি, বহদ্দারহাট, চাঁন্দগাও, পাথরঘাটা, চন্দনপুরাসহ ২০-২৫টি স্থানে বাড়তি নিরাপত্তা নিতে দেখা যায়।


হামলাকারীরা শনাক্ত হবে -স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর বলেছেন, কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধ মন্দির জ্বালিয়ে দেয়া, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও তাণ্ডবলীলার নেপথ্য হোতাদের আগামীকালের (আজ) মধ্যেই শনাক্ত করা হবে। যারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে- স্থানীয় বিএনপির সংসদ সদস্য ও তার অনুসারীরা এর সঙ্গে জড়িত। কারণ, সংসদ সদস্য ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে সমবেদনা প্রকাশ করেননি। অমরা সেখানে গেলে তিনি আমাদের সঙ্গেও দেখা করেননি। ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে গতকাল বিকালে হেলিকপ্টারযোগে পুরাতন বিমান বন্দরে নেমে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন- শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া, পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার, র‌্যাব ডিজি মোখলেছুর রহমান, বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আনোয়ার হোসেন, র‌্যাব ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের পরিচালক জিয়াউল আহসান এবং ডিজিএফআই প্রতিনিধি।
মন্ত্রী বলেন, বিষয়টির তদন্তে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ১০ দিনের মধ্যে এ কমিটিতে রিপোর্ট দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কোন গাফিলতি আছে কিনা তা-ও খতিয়ে দেখবে ওই কমিটি। মহীউদ্দীন খান আলমগীর বলেন, একটি সামপ্রদায়িক গোষ্ঠী পরিকল্পিভাবে এ হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে। শনিবার দিবাগত রাত ২টার দিকে বিষয়টি অবগত হই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে সরকারের পক্ষ থেকে ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়েছি। সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের সব ধরনের সহায়তা দেয়া হচ্ছে। তিনি জানান, শিল্প সংস্থার কর্মচারী উত্তম কুমার বড়ুয়ার ফেসবুক লিংক-এ কোরান শরিফে পা দিয়ে যে মহিলা বসে আছে সে বাংলাদেশী নয়। ছবিটি তোলা হয়েছে দেশের বাইরে থেকে। এক্ষেত্রে এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছে উত্তম কুমার। উত্তম কুমারের অবস্থান এখনও সরকার জানে না উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, তার বাবা নেই। মা ও বোনকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হেফাজতে নেয়া হয়েছে। এক প্রশ্নে তিনি বলেন, বিদেশী মৌলবাদী শক্তির ইন্ধনে যে সংঘবদ্ধ চক্রটি হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে তারাই এ ছবি তৈরি ও পোস্ট করার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে। বিষয়টিকে পরিকল্পিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, হামলা ও অগ্নিসংযোগের আগে সরকারের কাছে কোন ধরনের তথ্য ছিল না। মন্দির জ্বালিয়ে দেয়া এবং বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেয়ার ঘটনায় অপশক্তি গান পাউডার, কেরোসিন ও পেট্রল ব্যবহার করেছে। মন্ত্রী জানান, ঘটনার পর পরই অতিরিক্ত র‌্যাব, পুলিশ এবং সেনা মোতায়েন করায় বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। সারা দেশে সতর্কতা থাকায় উখিয়া এবং পটিয়ায় ষড়যন্ত্রকারীরা নাশকতায় পরিকল্পনা করেও সফল হতে পারেনি। দেশের কোথাও আর সামপ্রদায়িক অপশক্তি হামলা চালাতে পারবে না। তিনি আরও জানান, পরিস্থিতি এখন পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। যারা এ অপতৎপরতার সঙ্গে জড়িত তাদের সমূলে উৎপাটন করা হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, একজন-দু’জন নয় দুস্কৃতকারীদের সদস্য সংখ্যা অনেক। এ ঘটনায় যাতে কোন নির্দোষ ব্যক্তি শাস্তি না পায় সে বিষয়টিও খেয়াল রাখা হচ্ছে।


ধর্মে ধর্মে দ্বন্দ্ব লাগাতেই রামুর ঘটনা -তথ্যমন্ত্রী
তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, কক্সবাজারের রামুতে যে ঘটনা ঘটেছে, তা এক ধর্মের সঙ্গে আরেক ধর্মের দ্বন্দ্ব লাগানোর জন্যই ঘটানো হয়েছে। গতকাল তথ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তথ্যমন্ত্রী এ মন্তব্য করেন। তথ্যমন্ত্রী বলেন, বৌদ্ধ বসতিতে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক। এ ব্যাপারে দোষীদের প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এটা কোন সামপ্রদায়িক বা হানাহানির ঘটনা নয়। এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক ও সুপরিকল্পিত ঘটনা। বাংলাদেশের সামপ্রদায়িক রাজনীতির সঙ্গে জড়িত একটি কুচক্রী মহল ষড়যন্ত্রমূলকভাবে গুজব ছড়িয়ে এ ঘটনা ঘটিয়েছে। ওই গোষ্ঠীর স্থানীয় কয়েকজন শীর্ষ নেতা ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে এটা ঘটান। তাদের প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িতদের শিগগিরই গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনা হবে। তিনি বলেন, এটা জঙ্গিবাদের চক্রান্তমূলক কাজ। কোরানের কোন অবমাননা হয়নি। এটি ফেসবুকের একটি ফেইক আইডি থেকে করা হয়েছে। আর একে কেন্দ্র করে বৌদ্ধ বিহারে আগুন দেয়া হয়েছে। এ ধরনের গুজবে কান না দিতে তিনি সবার প্রতি আহ্বান জানান। রামুর ঘটনা সম্পর্কে সরকারের অবস্থান ও ঘটনাস্থলের সর্বশেষ পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গতকাল সচিবালয়ে ব্রিফিংয়ে উপস্থিত হন তথ্যমন্ত্রী। তিনি জানান, রামুতে ক্ষতিগ্রস্ত মন্দির ও বসতবাড়ি সরকারের অর্থে পুনঃনির্মাণ করে দেয়া হবে। র‌্যাব ও বিজিবির শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়ে স্বরাষ্ট্র ও শিল্পমন্ত্রী ঘটনাস্থলে রয়েছেন। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি ইতিমধ্যে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সানজিদা খানমও এ সময় উপস্থিত ছিলেন।


যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা ও  নৈরাজ্য সৃষ্টির লক্ষ্যে রামুতে হামলা -সৈয়দ আশরাফ
কক্সবাজারের রামু উপজেলায় বৌদ্ধ বিহার, মন্দির ও বৌদ্ধ বসতিতে হামলা, লুটপাট, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনায়  নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।  গতকাল এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, আমরা গভীর ক্ষোভ ও উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে, অতি সামপ্রতিককালে কতিপয় স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী নানা অজুহাতে দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপাসনালয়, ঘরবাড়ি, সম্পদ ও জানমালের ওপর আঘাত করছে। আমরা এই সব জঘন্য কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধে বিশ্বাসী সচেতন জনগণকে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানাচ্ছি। একই সঙ্গে বর্তমানে জামায়াত ও বিএনপির যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচারাধীন অপরাধীদের রক্ষা এবং অতীতের মতো দেশে সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, হানাহানি সৃষ্টি এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক মানবাধিকার হরণ করার উদ্দেশে নতুন করে যে ষড়যন্ত্রমূলক হামলা, সন্ত্রাস চালানো হচ্ছে সে ব্যাপারে আমি দেশবাসীকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানাচ্ছি। বিবৃতিতে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা বিরোধী চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী সামপ্রদায়িক গোষ্ঠী তাদের কৃতকর্মের বিচারের হাত থেকে রক্ষার জন্য মরণকামড় হানার চেষ্টা করছে। দেশে বিরাজমান সাম্প্রদায়িক সমপ্রীতি বিনষ্ট এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত করার হীন উদ্দেশ্যে সমপ্রতি এই গোষ্ঠীটি পার্বত্য চট্টগ্রাম, দিনাজপুরের চিরিরবন্দর, চট্টগ্রামের পটিয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর পরিকল্পিতভাবে হামলা চালাচ্ছে। দেশবাসীর ধর্মীয় অনুভূতিতে সুড়সুড়ি দিয়ে সেইসব অপশক্তি আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে এবং দেশের অন্যান্য স্থানে এই হামলা, সন্ত্রাস ছড়িয়ে দেয়ার অপচেষ্টা চালাচ্ছে।
সৈয়দ আশরাফ বলেন, আমরা যে কোন মূল্যে সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি বজায় রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ধর্মীয় সামপ্রদায়িক এবং নৃ-জাতিগত সংঘাত ও হামলা সৃষ্টির সঙ্গে জড়িত প্রকৃত অপরাধীদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে যথোচিত আইনানুগ কার্যকর ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষের প্রতি আমি আহ্বান জানাচ্ছি। সামপ্রদায়িক ও জঙ্গি গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে দেশের সকল গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল, ছাত্র, যুব, কৃষক, শ্রমিক, পেশাজীবী, রাজনৈতিক দল, ব্যক্তি, সংগঠন, সংস্থা এবং বিবেকবান নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক।

বিভিন্ন সংগঠনের উদ্বেগ, নিন্দা
রামু উপজেলা, চট্টগ্রামের পটিয়া ও শিকলবাহায় বৌদ্ধ ও হিন্দু সমপ্রদায়ের মন্দিরে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, লুটপাট ও অত্যাচারের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান কল্যাণ ফ্রন্ট, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটসহ আর বেশ কয়েকটি সংগঠন। বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মনজুরুল আহসান খান ও সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এক যুক্ত বিবৃতিতে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় মন্দিরে হামলা ও ভাঙচুর এবং বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকদের ওপর আক্রমণ,  বাড়িঘরে লুটপাট ও ভাঙচুরে ঘটনায় গভীর ক্ষোভ ও উদ্বেগ জানিয়েছেন। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান কল্যাণ ফ্রন্টের নেতৃবৃন্দ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে কক্সবাজার জেলার রামু উপজেলাসহ বিভিন্ন এলাকায় বৌদ্ধ মন্দিরে ভাঙচুরের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে। বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ পৃথক বিবৃতিতে এ ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে।

No comments:

Post a Comment