Wednesday, December 29, 2010

‘রাজধানীর দক্ষিণখানে খুন ও ডাকাতির মামলা রাজনৈতিক বিবেচনার শিকার’: পলাতক আসামিকেও মামলা থেকে খালাস

‘রাজনৈতিক বিবেচনায়’ রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বহুল আলোচিত প্রকৌশলী আব্দুল হামিদ বিশ্বাস হত্যা মামলার প্রধান পাঁচ আসামির নাম প্রত্যাহারের আদেশ দিয়েছেন আদালত। গতকাল মঙ্গলবার ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক কানিজ আখতার নাসরীনা খানম এই আদেশ দেন। এতে বিচারাধীন মামলাটির এজাহারভুক্ত এই পাঁচ আসামি— জয়নাল আবেদীন মোল্লা, শাহীন, শরীফ, হুমায়ুন ও ইকবাল হোসেন খালাস পেলেন। তাঁদের মধ্যে হুমায়ুন ও শাহীন প্রায় ছয় বছর ধরেই পুলিশের খাতায় পলাতক আসামি।

মামলার নথিপত্রে দেখা যায়, রাজধানীর দক্ষিণখানে ডাকাতিকালে চিনে ফেলায় আসামিদের মধ্যে শাহীন নিজ হাতে প্রকৌশলী হামিদকে গুলি করেছেন বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ রয়েছে। উত্তরা থানার এই মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত মোট ১০ জন আসামির মধ্যে বাকি পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা চলবে। তাঁরা হলেন লিটন ওরফে সুন্দরী লিটন, আশরাফুল ইসলাম ওরফে দীপু, জাকির হোসেন, ফিরোজ মিয়া ও নিরঞ্জন চন্দ্র পাল। তাঁদের মধ্যে জাকির ও নিরঞ্জন পলাতক। নথিপত্রে দেখা যায়, এই পাঁচজনের নাম এজাহারে ছিল না, তদন্তে তাঁদের জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে বলে অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে।
এদিকে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, ডাকাতি ও হত্যার অভিযোগে করা এই মামলার বাদী ও আসামিদের কেউই কোনো রাজনৈতিক দলের কোনো পদে নেই। তবু আসামিদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত ২৬ আগস্ট এ মামলাটি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর রাষ্ট্রপক্ষ বিচারিক আদালতে প্রত্যাহারের আবেদন করে।
এ ঘটনায় প্রথম আলোতে গত ২২ ডিসেম্বর ‘খুন ও ডাকাতির মামলা রাজনৈতিক বিবেচনার শিকার’ শিরোনামে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
ঘটনা: ২০০৫ সালের ২৯ জানুয়ারি রাজধানীর দক্ষিণখানের আনল এলাকায় নিজ বাসায় দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হন প্রকৌশলী আব্দুল হামিদ বিশ্বাস। আহত হয় তাঁর স্কুলপড়ুয়া মেয়ে। দুর্বৃত্তরা আলমারি ভেঙে বিভিন্ন মালামাল নিয়ে যায়। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী নিহতের স্ত্রী সাঈদা হামিদ বাদী হয়ে উত্তরা থানায় হত্যা ও ডাকাতির মামলা করেন। একই বছরের ৮ আগস্ট পুলিশ ১০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়। এরপর মামলাটির বিচার শুরু হয়। ২০০৬ সালে মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে যায়। ইতিমধ্যে তদন্ত কর্মকর্তা ছাড়া বাকি সব সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। মামলাটি প্রায় শেষপর্যায়ে ছিল বলে আইনজীবীরা জানান।
বাদী সাঈদা হামিদের ভাই আফজাল হোসেন জানান, খুনের মামলাটি তুলে নিতে আসামি জয়নাল মোল্লা ও তাঁর পরিবার নানাভাবে চাপ দিচ্ছিল। চাপের মুখে ২০০৭ সালে সাঈদা হামিদ বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে মেয়েদের নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান।
সাঈদা হামিদ টেলিফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘জয়নাল মোল্লা তাঁর দুই ছেলে, জামাতাসহ অন্য কয়েকজনকে নিয়ে রাত তিনটার দিকে আমাদের বাসার ভেতরে ঢোকেন। শব্দ শুনে আমরা বাতি জ্বালিয়ে দেখতে যাই, কী হচ্ছে। আমি, আমার দুই মেয়ে ও কাজের মেয়ের চোখের সামনেই জয়নাল মোল্লার ছেলে শাহীন নিজ হাতে গুলি চালিয়েছেন।’
প্রতিক্রিয়া: এদিকে ‘রাজনৈতিক হয়রানির বিবেচনায়’ মামলার পলাতক আসামিসহ প্রধান পাঁচ আসামির নাম প্রত্যাহারে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন মামলার বাদী যুক্তরাষ্ট্র-প্রবাসী সাঈদা হামিদ। তিনি গতকাল টেলিফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘তারা আমার স্বামীকে আমার চোখের সামনে গুলি করে হত্যা করেছে। এ জন্য রাষ্ট্রের কাছে বিচার চাইলাম। রাষ্ট্রই মামলা তুলে নিল। এখন কার কাছে যাব?’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমরা রাজনীতি করি না বলে কি আমরা বিচার পাব না? আমরা কি বাংলাদেশের মানুষ না!’
সাঈদা হামিদ এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
বাদীর পক্ষে মামলাটির তদারককারী সাঈদার ভাই আফজাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এই আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আবেদন করবেন।
এই ব্যাপারে ট্রাইব্যুনালের বিশেষ কৌঁসুলি সামছুল হক সাংবাদিকদের বলেন, সরকার মামলাটি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ কারণে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৪ ধারায় আবেদন করা হয়েছে। আদালত যাঁদের নাম প্রত্যাহারযোগ্য মনে করেছেন, তাঁদের নাম প্রত্যাহার করে খালাস দিয়েছেন।

No comments:

Post a Comment