Thursday, December 16, 2010

হা-মীমের কারখানায় আগুন নিয়ে রহস্য ২১ লাশ হস্তান্তর (কালের কন্ঠের সৌজন্যে)

শুলিয়ায় হা-মীম গ্রুপের পোশাক কারখানায় আগুন লাগার ঘটনায় গতকাল বুধবার পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ বের করা যায়নি। দ্যাটস ইট স্পোর্টসওয়্যার লিমিটেডের ১১ তলা ভবনে মঙ্গলবারের ওই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডকে ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে রহস্যময়তা। দুর্ঘটনার পরপর কর্তৃপক্ষ প্রাথমিক ধারণা থেকে জানিয়েছিল, শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে। কিন্তু গতকাল তাদের এক প্রতিনিধি বলেছেন, দুপুরে আগুন লাগার সময় ১০ তলায় বিদ্যুৎ ছিল না।


আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়া নিয়ে বিস্মিত মালিক-কর্তৃপক্ষ। তাঁরা এটিকে নিছক দুর্ঘটনা বলে মনে করছেন না। তবে নাশকতা বলেও সরাসরি দাবি করেননি তাঁদের কেউ। কর্তৃপক্ষ কারখানায় দুদিনের ছুটি ঘোষণা করেছে। দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটন ও দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের দাবিতে গতকাল কারখানার প্রধান ফটক ও ভবনের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করেন শ্রমিকরা। পরে মালিকপক্ষের আশ্বাসের ভিত্তিতে তাঁরা শান্ত হন।
হা-মীম গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক কর্নেল (অব.) দেলোয়ার হোসেন জানান, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে ২১টি লাশ পাঠানো হয়েছিল। গতকাল সব লাশ তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
অগি্নকাণ্ডের ফলে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ এখনো নির্ধারণ করা যায়নি। তবে কারখানা ভবনের দশম তলার ফিনিশিং সেকশনের গোডাউন ও কার্টনে ভরা সব পোশাক পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আগুনের তাপে গলে গেছে মেশিনপত্র। পুড়ে গেছে একাদশ তলাও। ফাটল দেখা দিয়েছে ভবনের দেয়ালের কয়েকটি অংশে।
আগুন লাগা নিয়ে নানা প্রশ্নের বিষয়ে কর্নেল (অব.) দেলোয়ার হোসেন গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'দুর্ঘটনার সময় দশম তলায় বিদ্যুৎ থাকার কথা নয়। আগুন কিভাবে লাগল বা দ্রুত ছড়াল তা নিয়ে তদন্ত চলছে। আমি এখনই নাশকতা বলে মন্তব্য করতে পারি না। এখানে কিছু রহস্য আছে।' শ্রমিকদের অভিযোগ, আগুন লাগলেও সঙ্গে সঙ্গে ইমারজেন্সি বেল বাজেনি। তাই আগুন লাগার ঘটনা দ্রুত টের পাওয়া যায়নি। একাদশ তলার ক্যান্টিন থেকে নিচে নামার সময় একদিকে আগুন, অন্যদিকে কলাপসিবল গেট বন্ধ থাকার কারণে আটকা পড়তে হয় শ্রমিকদের।
কেউ নিশ্চিত নয় : অগি্নকাণ্ডের পর সরকার ও বিজিএমইএর পক্ষ থেকে দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এসব কমিটি কাজ শুরু করেছে। আগুনের সূত্রপাতের বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস গতকাল পর্যন্ত নিশ্চিত হতে পারেনি। ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে গতকাল পরিচালক (অপারেশন) ভরত চন্দ্রকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবু নাঈম মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'প্রাথমিকভাবে আমরা ধারণা করেছিলাম বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটই কারণ। তবে এ বিষয়ে আমরা নিশ্চিত নই। তদন্ত কমিটি কাজ করছে। আমরা আমাদের মতো তদন্ত শুরু করেছি।' ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটি সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে বলে জানান মহাপরিচালক।
ফায়ার সার্ভিসের ডিইপিজেড স্টেশনের কর্মীরা গতকাল দুপুরেও কারখানার দশম তলায় অনুসন্ধান চালান। স্টেশন অফিসার অপূর্ব বল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এখন ডাম্পিং ডাউন চলছে। ভেতরে আগুন জ্বলছে কি না, লাশ আছে কি না তা দেখা হচ্ছে। কর্তৃপক্ষকে পুড়ে যাওয়া কাপড় সরাতে বলা হয়েছে। তারা কাপড় সরালে কাজ শেষ হবে।'
দুর্ঘটনার কারণ ও সিঁড়িপথের কলাপসিবল গেট বন্ধ থাকা প্রসঙ্গে অপূর্ব বল বলেন, 'দশম তলার ফিনিশিং গোডাউনে কাপড়ের স্টকের পাশে প্যানেল বোর্ড থেকে আগুন লেগেছে বলে কয়েকজন কর্মী জানিয়েছে। এ বিষয়ে বিভাগীয় তদন্ত চলছে। পশ্চিম পাশের একটি গেটে আমরা ভাঙা তালা ঝুলতে দেখেছি।'
বেল বাজে দেরিতে : কারখানার একাদশ তলার স্যাম্পল সেকশনে কাজ করেন আবদুল হামিদ মিলন। তিনি কাপড় বেয়ে নামার সময় তৃতীয় তলা থেকে পড়ে আহত হন। মিলন এখন আশুলিয়ার ডক্টরস হাসপাতালে ভর্তি আছেন। তিনি জানান, দুপুরে ক্যান্টিনে খাওয়ার সময় হঠাৎ সিকিউরিটি গার্ড গিয়ে বলেন_নিচে নেমে যান, আগুন লেগেছে। ওই সময় কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায় চারপাশ। এর অন্তত পাঁচ মিনিট পর বেল বাজার শব্দ শুনতে পান মিলন। খাবার ফেলে উঠে তখন আর নামা যায়নি। আশপাশে ৫০-৬০ জনকে আটকা পড়তে দেখেন তিনি। মিলনের দাবি, দড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে পড়ে ঘটনাস্থলেই মারা গেছেন রাসেল, শাহ আলম, ইকরাম ও সেলিম। তাঁরা একসঙ্গে একাদশ তলায় কাজ করতেন।
একাদশ তলায় খাবার খেতে যাওয়া মিলনের সহকর্মী রাজু এবং ষষ্ঠ তলার সুইপিং সেকশনের বাছেদ ও আরিফুল ইসলামও জানান, তাঁরা আগুনের বিষয়টি প্রথমে টের পাননি। আগুন-আগুন বলে চিৎকার শোনার অন্তত পাঁচ থেকে দশ মিনিট পর তাঁরা বেল শুনতে পান।
নিজস্ব পানি সরবরাহ ছিল না : একাদশ তলার স্যাম্পল সেকশনের ইনচার্জ এম এ রজব জানান, আগুন লাগার পর তিনি অন্য কর্মীদের আগে নামতে বলে পরে নামেন। তখন আগুন নেভাতে গিয়ে তিনি পানির পাইপলাইনে পানি পাননি। তাই প্রাথমিক অবস্থায় কর্মীরা চেষ্টা করলেও আগুন নেভাতে পারেননি বলে দাবি করেন তিনি।
কালো ধোঁয়াই দায়ী_কর্তৃপক্ষ : কালো ধোঁয়া আর হঠাৎ আগুনের কারণে সবাই নিচে লাফিয়ে পড়েন বলে দাবি করেছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। উপব্যবস্থাপনা পরিচালক দেলোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠের এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, 'কালো ধোঁয়া আর হঠাৎ আগুন দেখে কর্মীরা লাফিয়ে পড়েন। গেট খোলা ছিল।' ইমারজেন্সি বেল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'আমরা দুই পদ্ধতিতেই জরুরি বেল বাজাই। বিদ্যুৎ না থাকলে প্রথমে মুখে জানানোর পর হাতের সাহায্যে বেল বাজানো হয়।'
আর লাশ মেলেনি, ২১ লাশ হস্তান্তর : কারখানায় অগি্নকাণ্ডের ঘটনায় গতকাল আর কোনো লাশ উদ্ধার হয়নি। রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত আহতদের মধ্যে কারো মৃত্যুর খবরও পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যমতে নিহতের সংখ্যা ২৮ হলেও কারখানা কর্তৃপক্ষ ২১ জন মারা গেছেন বলে দাবি করেছে। কোনো কোনো গণমাধ্যমে অসমর্থিত সূত্রের বরাত দিয়ে নিহতের সংখ্যা আরো বেশি বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। বিভিন্ন হাসপাতালে এখনো ৩৬ জন চিকিৎসাধীন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। গতকাল বিকেল পর্যন্ত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গ থেকে ২১ জনের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
ঢাকা জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আবুল বাশার মোহাম্মদ ফারুকুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'দুপুর আড়াইটার মধ্যেই ২১ জনের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।'
গতকালও বিভিন্ন হাসপাতালে অন্তত ৩৬ জন ভর্তি ছিলেন। হাসপাতাল ঘুরে জানা গেছে, সিনসিন হাসপাতালে ১২ জন, ডক্টরস হাসপাতালে ১০ জন, সাভার সিএমএইচ হাসপাতালে ছয়জন, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তিনজন, পঙ্গু হাসপাতালে দুজন, সাভারের এনাম মেডিক্যাল হাসপাতালে দুজন আহত ব্যক্তি ভর্তি আছেন। আহতদের বিষয়ে খোঁজখবর নিতে শুরু করেছে কারখানা কর্তৃপক্ষ।
অভিযোগকেন্দ্র স্থাপন : গতকাল দুপুরে কারখানা ভবনের নিচতলায় অভ্যর্থনা কক্ষে অভিযোগকেন্দ্র খুলেছে কর্তৃপক্ষ। দুপুর ২টা পর্যন্ত নিখোঁজ বা আহতের কোনো খবর ছিল না অভিযোগকেন্দ্রে।
ক্ষতির পরিমাণ জানা যায়নি : হা-মীম গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক লে. কর্নেল (অব.) দেলোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে জানান, 'বিশাল কারখানা ভবনের দুটি ফ্লোর পুরো ধ্বংস হয়ে গেছে। সম্পূর্ণ প্রস্তুত পোশাকসহ অসংখ্য কার্টন পুড়ে গেছে। কারখানার মেশিনগুলো গলে গেছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এত ব্যাপক যে তা এখনো নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি।' এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'গত বছরের অগি্নকাণ্ডের ক্ষতির চেয়ে এবারের ক্ষতি অনেক বেশি।'
বিজিএমইএ সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী গতকাল সন্ধ্যায় ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কিছু বলতে না পারলেও এর ব্যাপকতা সম্পর্কে ধারণা দিয়ে বলেন, কারখানার দুটি ফ্লোর পুরো 'নাই' হয়ে গেছে। দশম তলায় ফিনিশিং সেকশনে হাজার হাজার কার্টন তৈরি পোশাক রপ্তানির জন্য প্রস্তুত ছিল। আরো বিপুল পরিমাণ পোশাক ইস্ত্রি করার পর কার্টনে ভরার জন্য রাখা ছিল। ফিনিশিং গোডাউন পুরোপুরি ছাই হয়ে গেছে। তিনি বলেন, 'হা-মীম গ্রুপ বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের নামকরা প্রতিষ্ঠান। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বড় বড় প্রতিষ্ঠান তাদের তৈরি পোশাকের ক্রেতা। পুড়ে যাওয়া পোশাক ওই সব প্রতিষ্ঠানের অর্ডার করা। এখন গ্রুপটি এ বিপুল পরিমাণ পোশাক কোথা থেকে সংগ্রহ করে বিদেশি ক্রেতাদের দেবে?'
গতকাল আশুলিয়ার নরসিংহপুরের কারখানাটি সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, গতবারের আগুনে পোড়া তিনতলা একটি কারখানা ভবন পরিত্যক্তের মতো পড়ে আছে। বিশাল আয়তনের টিনশেড সোয়েটার ফ্যাক্টরিগুলোর পোড়া মেশিনের স্তূপ পড়ে আছে কারখানা প্রাঙ্গণে। প্রায় দেড় বছর পরও ক্ষতচিহ্ন দেখে স্পষ্ট হয়ে ওঠে তখনকার বিপুল ক্ষতির চিত্র।
=========================

No comments:

Post a Comment