Thursday, December 16, 2010

ট্রেন দুর্ঘটনাঃ চালকের চা পান তত্ত্ব নিয়ে প্রশ্ন by সুমন মোল্লা

রসিংদীতে দুর্ঘটনাকবলিত চট্টলা ট্রেনটি ভৈরবে যাত্রাবিরতি করেছিল মাত্র চার মিনিট। একটি ইঞ্জিন ও ১৭টি বগি নিয়ে ট্রেনটি ভৈরবের আগের স্টেশন আশুগঞ্জ ছেড়ে আসে বিকেল তিনটা ৫৮ মিনিটে। ভৈরব স্টেশনে যাত্রাবিরতি করে চারটা আট মিনিটে। মাত্র চার মিনিট অবস্থান করে চারটা ১২ মিনিটে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যায় ট্রেনটি। ভৈরবের পরের স্টেশন দৌলতকান্দি অতিক্রম করে চারটা ২০ মিনিটে। ঢাকাগামী চট্টলা ট্রেনটির এই সময়সূচি গত বছরের ডিসেম্বরের। ভৈরব রেলস্টেশনের তথ্যকেন্দ্র থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

রেলওয়ের দুটি তদন্ত প্রতিবেদনে ভৈরব স্টেশনে চা পান করে চালকের অচেতন হয়ে পড়াকে দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। দুর্ঘটনার এ কারণ জানার পর রেল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যেই এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
ভৈরবের স্টেশন মাস্টার আবদুল মোতালিব প্রথম আলোকে বলেন, ভৈরব ছেড়ে যাওয়ার পর বিমানবন্দর ছাড়া আর কোনো স্টেশনে যাত্রাবিরতি নেই চট্টলার। ট্রেনটি ভৈরব স্টেশনে আসার নির্ধারিত সময় বেলা দুইটা এবং যাত্রাবিরতির সময় তিন মিনিট। দুর্ঘটনার দিন ট্রেনটি দুই ঘণ্টা আট মিনিট বিলম্বে ভৈরব স্টেশনে আসে এবং চার মিনিট যাত্রাবিরতি করে।
ভৈরব স্টেশনের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্ল্যাটফরম ছাড়া ভৈরব স্টেশনের আর কোথাও চায়ের দোকান নেই। তা ছাড়া ফেরি করেও এই স্টেশনে চা বিক্রি করতে দেওয়া হয় না। ট্রেনটি থামার পর ইঞ্জিনসহ সাতটি বগি প্রধান প্ল্যাটফরমের বাইরে চলে যায়। অর্থাৎ ইঞ্জিনটি চলে যায় চায়ের দোকান থেকে তিন থেকে চার শ ফুট সামনে। দ্রুতগতিতে হেঁটে এলেও আসা-যাওয়ায় তিন মিনিট লাগে। আর এক কাপ চা তৈরি করতে অন্তত দেড় থেকে দুই মিনিট সময় লাগে। এই সময়ের মধ্যে তিন থেকে চার শ ফুট পিছিয়ে এসে চা কিনে ফ্লাস্কে ভরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
কর্মকর্তাদের অনেকে স্মরণ করিয়ে দেন যে ২০০৮ সালে চট্টগ্রাম মেইল ট্রেনের চালক সংকেত অমান্য করে গাজীপুরের পুবাইল স্টেশনের কাছে চলে যায়। অন্য একটি ট্রেনের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হওয়ার আগমুহূর্তে পুলিশ ও পরিচালক চেইন টেনে ট্রেনটি থামান। ওই ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদনে একই কারণ উল্লেখ করা হয়েছিল। ওই ঘটনায় দুজন চায়ের দোকানিকে জেল খাটতে হয়। পরে বিষয়টি নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হন তদন্ত কমিটির সদস্যরা।
ভৈরব রেলওয়ে তথ্যকেন্দ্র সূত্র জানায়, ভৈরব থেকে নরসিংদী স্টেশনের দূরত্ব ৩০ কিলোমিটার। আর ভৈরব থেকে নরসিংদীর আমিরগঞ্জ স্টেশনের দূরত্ব ২৫ কিলোমিটার।
তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, চা পানের পর দৌলতকান্দি, শ্রীনিধী, মেথিকান্দা, হাঁটুভাঙ্গা, খানাবাড়ী ও আমিরগঞ্জ স্টেশন পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটার পথ নিয়মের মধ্যে অতিক্রম করে ট্রেনটি। আমিরগঞ্জ স্টেশন ছাড়ার পর পাঁচ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে গিয়ে অচেতন হয়ে পড়েন চালক।
গতকাল সকালে ভৈরব স্টেশনে গিয়ে ২ নম্বর প্ল্যাটফরমে ছয়টি চায়ের দোকান দেখা যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে কাছের চায়ের দোকানের কর্মচারী রবি মিয়া জানান, বুধবার তাঁরা ট্রেনের কোনো চালকের কাছে চা বিক্রি করেননি। পাশের চা-দোকানি জামাল মিয়া বলেন, পানি ফুটানো থাকলে এক কাপ চা তৈরি করতে দুই মিনিট সময় লাগে। চা-দোকানি মোস্তফা মিয়া বলেন, তাঁদের এখানে কাউকে ফেরি করে চা বিক্রি করতে দেওয়া হয় না।
বিভাগীয় পর্যায়ের তদন্ত কমিটির প্রধান ঢাকা বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সহকারী চালকের দেওয়া বক্তেব্যের আলোকে আমাদের প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।’
উচ্চপর্যায়ের কমিটি-প্রধান রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলী ইউসুফ আলী মৃধা গতকাল মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, তদন্তে প্রমাণ মিলেছে, চালক সংকেত অমান্য করে পাঁচ হাজার ৯৩২ ফুট সামনে এগিয়ে যায়। কোনো কারণে অচেতন না হলে এমনটা করা সম্ভব নয়।
মাত্র চার মিনিটে ট্রেন থেকে নেমে চা কিনে আবার ট্রেন চালিয়ে নেওয়া কীভাবে সম্ভব? এমন প্রশ্নের উত্তরে প্রধান প্রকৌশলী বলেন, অনেক সময় চলন্ত ট্রেন থেকে সহকারী চালক প্ল্যাটফরমে নেমে যান। এর চেয়ে বেশি মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
এদিকে তদন্ত প্রতিবেদনে ভৈরব স্টেশন থেকে সব ধরনের চায়ের দোকান তুলে দেওয়ার সুপারিশ করার পর গতকাল প্ল্যাটফরম পরিদর্শনে আসেন ঢাকার বিভাগীয় সহকারী বাণিজ্যিক কর্মকর্তা আবু সায়িদ এবং চট্টগ্রাম নিরাপত্তা পুলিশের সহকারী কমান্ডার নাজমুল নেওয়াজ। তাঁরা এসে অবৈধ দোকানপাট উচ্ছেদ করেন এবং বৈধ দোকানগুলো নিয়ম অনুযায়ী চলছে কি না, খতিয়ে দেখেন।
প্রসঙ্গত, ৮ ডিসেম্বর বিকেলে নরসিংদীতে চট্টগ্রামগামী আন্তনগর মহানগর গোধূলী ও ঢাকাগামী চট্টলা ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে এক চালকসহ অন্তত ১৩ জন নিহত হন। দুর্ঘটনায় চট্টলা ট্রেনের একটি বগি মহানগর ট্রেনের ইঞ্জিনের ওপর উঠে যায়। এতে দুটি ট্রেনের ইঞ্জিন দুমড়েমুচড়ে যায় এবং তিনটি বগি সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

No comments:

Post a Comment