Thursday, December 16, 2010

হা-মীম গ্রুপের কারখানায় অগ্নিকাণ্ডঃ নেভানোর ব্যবস্থা ছিল, কাজে লাগেনি

শুলিয়ার নরসিংহপুর এলাকায় হা-মীম গ্রুপের পোশাক কারখানায় শর্টসার্কিট থেকে আগুন লেগেছে বলে মনে করছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষ। তবে হা-মীম গ্রুপের পক্ষ থেকে এ ধারণা নাকচ করে দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় পুলিশ এ ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে। এদিকে আগুন নেভানোর মতো যন্ত্রপাতি ওই ভবনে থাকলেও তা কাজে লাগেনি। শ্রমিকেরা জানান, তাঁদের এ ব্যাপারে কোনো প্রশিক্ষণ ছিল না।
অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রগুলো অক্ষতই আছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবু নাঈম মো. শাহিদউল্লাহ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছে শর্টসার্কিট থেকে আগুন লেগেছে। তদন্ত করে বিষয়টি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানা যাবে।
জানতে চাইলে হা-মীম গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক দেলোয়ার হোসেন জানান, শ্রমিকদের মধ্যাহ্নবিরতির সময় সব তলার মেইন সুইচ বন্ধ করে দেওয়া হয়। মঙ্গলবারও দশম তলায় মধ্যাহ্নবিরতির সময় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ছিল। এ কারণে শর্টসার্কিটের আশঙ্কা কম। নাশকতার আশঙ্কা করা হচ্ছে কি না—জানতে চাইলে তিনি বলেন, তদন্তে সব তথ্য বের হয়ে আসবে।
আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সিরাজুল ইসলাম বলেন, নাশকতার অভিযোগ পেলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ বিষয়ে কারখানা কর্তৃপক্ষ থানায় একটি জিডি করেছে।
গত মঙ্গলবার দুপুরে আশুলিয়ার নরসিংহপুর এলাকায় হা-মীম গ্রুপের পোশাক কারখানার ১০ ও ১১ তলায় আগুন লেগে ২৬ জনের মৃত্যু হয়। এদের মধ্যে ২৩ জনের নাম-পরিচয় মিলেছে। তিনজনের ব্যাপারে কেউ কোনো কিছু জানাতে পারছেন না। এ ঘটনায় আহত হন দুই শতাধিক শ্রমিক। গতকাল অনেকে অভিযোগ করেন, তাঁরা স্বজনদের কোনো খোঁজ পাচ্ছেন না।
আগুনে পুড়ে যাওয়া ১০ ও ১১ তলা পুরো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। আগুনে ছাদের পলেস্তারা খসে রড বেরিয়ে গেছে, ফাটল ধরেছে বিভিন্ন জায়গায়। দশম তলার এক পাশে ফিনিশিং আর অন্য পাশে প্যাকেজিং বিভাগ। প্যাকেজিং বিভাগের এক পাশজুড়ে ছিল স্তূপ করে রাখা পোশাক। এই কাপড়গুলো থেকেই আগুনের সূত্রপাত বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি।
মঙ্গলবার দুপুরে দশম তলায় নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা হেলালউদ্দীন জানান, প্যাকেজিং বিভাগের এক কোণ থেকে (ভবনের পশ্চিম-দক্ষিণ) আগুনের সূত্রপাত হয়। আগুন খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রচণ্ড কালো ধোঁয়া বের হতে থাকে। তবে তখন দশম তলায় খুব বেশি শ্রমিক ছিলেন না। তাঁরা সবাই মধ্যাহ্নবিরতিতে বাইরে অথবা ক্যানটিনে ছিলেন।
শ্রমিকেরা জানান, প্রায় ছয় মাস আগে হা-মীম গ্রুপ ১১ তলার টিনের স্থাপনাটি সরিয়ে নেওয়ার কথা তাদের জানিয়েছিল। কিন্তু সরানো হয়নি। ছাদটা ফাঁকা থাকলে অনেক মানুষকে সেখান থেকে হেলিকপ্টারে করে সরিয়ে নেওয়া যেত। এ ছাড়া অগ্নিনির্বাপণের জন্য হাইড্রেন্ট বা স্প্রিংকলারও ছিল না। সহনীয় মাত্রার চেয়ে তাপমাত্রা বেশি হলে স্প্রিংকলার থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পানি বের হয়। কারখানাটির ব্যবস্থাপনা বলতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র আর কিছু হোস পাইপ। সেগুলোও ঠিকমতো কাজ করেনি।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আরও জানান, কারখানার দশম তলার ছাদে চুইয়ে চুইয়ে পানি পড়ছে, পুরো ভবনটি না হলেও কয়েকটি তলা বেশ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
এসব অভিযোগের ব্যাপারে কারখানার উপপরিচালক দেলোয়ার হোসেন জানান, অগ্নিনির্বাপণের জন্য হাইড্রেন্ট আছে, পর্যাপ্তসংখ্যক অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রও আছে। দরজায় তালা দেওয়ার অভিযোগও অস্বীকার করেন তিনি।
কর্তৃপক্ষের পূর্বঘোষণা অনুযায়ী গতকাল সকালে শ্রমিকেরা কাজে যোগ দিতে আসেন। নিচের তলাগুলোতে তাঁরা মেশিনে বসলেও কাজ করেননি। ‘সহকর্মীদের লাশ ফেরত চাই’ স্লোগান তুলে তাঁরা বিক্ষোভ করে কারখানা থেকে বের হয়ে আসেন। তাঁরা কারখানা প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ মিছিলও করেন।
বিক্ষোভে অংশ নেওয়া নিটিং অপারেটর মিজানুর রহমান জানান, আগুন লাগার সময় কারখানায় অনেক লোক ছিল। তাদের অনেককেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। নিরাপত্তাকর্মীরা পেছনের দরজাগুলোতে তালা মেরে দেন। আর সামনের দিকে আগুন জ্বলছিল। ফলে শ্রমিকেরা ১১ তলা থেকে দড়ি অথবা কাপড় দিয়ে ঝুলে ঝুলে নামতে বাধ্য হয়েছেন।
স্বজনের সঙ্গে শেষ কথা: নিখোঁজ স্বজন, বন্ধু আর সহকর্মীদের খুঁজতে গতকাল সকাল থেকে কারখানার প্রধান ফটকে ভিড় জমায় অনেক মানুষ। হাসপাতাল, মর্গে ঘুরে ঘুরে আর পত্রিকার পাতায় প্রিয়জনকে খুঁজে না পেয়ে তারা ভিড় জমায় কারখানার গেটে। এ রকমই একজন রঞ্জু মিয়া। তিনি খুঁজতে এসেছেন স্ত্রী শাহনাজ বেগম আর ভাতিজি শাহনাজকে। বোন শাহীন আর ভগ্নিপতি ওমর ফারুকের খোঁজে এসেছেন নাজমা। চাচাতো ভাই নজরুল ইসলামের খোঁজে এসেছেন জাহাঙ্গীর আলম। মেয়ে রাজিয়ার খোঁজে এসেছেন সুফিয়া বেগম। ছেলে হালিমকে খুঁজতে এসেছিলেন বাবা সাত্তার।
ধ্বংসস্তূপ থেকে: ভবনের ১১ তলার ক্যানটিনের পাশেই ভবনটির সবচেয়ে সুসজ্জিত প্রদর্শনী কক্ষ (ডিজাইন স্টুডিও)। এখানেই বিদেশি ক্রেতাদের বসানো হতো ও নমুনা দেখানো হতো। পুরো প্রদর্শনী কক্ষটি পুড়ে কালো হয়ে রয়েছে। কোনো কিছুই আস্ত নেই। তাপে কুঁকড়ে গেছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র, ফ্রিজ আর মাইক্রোওয়েভ ওভেন। আধা গলে যাওয়া মূর্তিগুলো (ম্যানিকুইন) দাঁড়িয়ে রয়েছে বিধ্বস্ত অবস্থায়। কক্ষটির পাশেই নমুনা হিসেবে রাখা কাপড়ের স্তূপ পুড়ে কয়লা হয়ে আছে।
তল্লাশি: ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা মঙ্গলবার সন্ধ্যার মধ্যেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হন। তবে রাত নয়টার দিকে আগুন একদম নিভে যায়। রাত ১১টার দিকে ফায়ার সার্ভিস ও রেড ক্রিসেন্টের কর্মীরা পুড়ে যাওয়া তলাগুলোতে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও আর কোনো লাশ পাননি। রাত দেড়টার দিকে অভিযান স্থগিত করা হয়। সকালে আরেক দফা তল্লাশি চালায় ফায়ার সার্ভিস।
২০টি লাশ হস্তান্তর: ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে কাল ২০টি লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ঢাকার জেলা প্রশাসন লাশ হস্তান্তর করে।
নিহতরা হলেন দিনাজপুরের মোজাম্মেল হোসেন (৫২), ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মারুফ (২২), বরগুনার তানিয়া সুলতানা (১৮), জামালপুরের অঞ্জনা (২৮), দিনাজপুরের ফরিদুল (৩৫), ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হালিমা (২৫), বগুড়ার রুহুল আমিন (২৯), মাদারীপুরের রাসেল (২৫), ময়মনসিংহের বাবুল (২৩), মানিকগঞ্জের হিমেল (২৮), গাইবান্ধার রেজাউল মণ্ডল (২২), বরিশালের রুনা (৩০), ফরিদপুরের দেলোয়ার চৌধুরী (৩০), ফরিদপুরের মানসুরা (৩০), বাগেরহাটের মামুম খান (৩৪), সিরাজগঞ্জের সেলিম রেজা (২০), বগুড়ার শাহীনুর রহমান (৩৮), যশোরের ইমরান (২৮), মানিকগঞ্জের চান মিয়া (২৫) ও রংপুরের সুজন (২২)। গতকাল অজ্ঞাত দুজন মারা যান।
==========================
গোলাম মর্তুজা ও অরূপ রায়, আশুলিয়া থেকে | তারিখ: ১৬-১২-২০১০

No comments:

Post a Comment