Friday, May 25, 2012

মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদনঃ বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি ভয়াবহ

বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির তীব্র সমালোচনা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। বলেছে- নিখোঁজ, নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যু, খেয়ালখুশি মতো গ্রেফতার ও আটক রাখার জন্য দায়ী নিরাপত্তা বাহিনী।

তারা মানবাধিকারের বড় সমস্যা। বিচার বিভাগকে অতিমাত্রায় রাজনীতিকরণ করা হয়েছে । এতে সমস্যা বেড়েছে। বিরোধী দলের সদস্যদের ন্যায় বিচার পাওয়ার পথকে সঙ্কুচিত করা হয়েছে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সীমিত করেছে সরকার। এক্ষেত্রে সেলফ সেন্সর চলছেই। নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা সাংবাদিকদের হয়রানি করছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক মানবাধিকার বিষয়ক রিপোর্টে এসব কথা বলা হয়েছে।
ঢাকাস্থ আমেরিকান দূতাবাস জানায়, বৃহস্পতিবার ওয়াশিংটন সময় সকাল সাড়ে ১১টায় (বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ৯টা) যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দফতরের বাৎসরিক মানবাধিকার প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।

২০১১ সালের ওপর করা ওই রিপোর্টে বাংলাদেশ চ্যাপ্টারে বলা হয়েছে, সরকার সমাবেশ করার স্বাধীনতাকে খর্ব করেছে। এছাড়া রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপূর্ণ সহিংসতা সমস্যাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। সরকারি পর্যায়ে দুর্নীতি মারাত্মক এক সমস্যা। শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতাও বড় একটি সমস্যা। শ্রমিকদের অধিকার সীমিত করা, শিশু শ্রম, কর্মক্ষেত্রে অনিরাপত্তা রয়েই গেছে। অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ ক্ষমা মারাত্মক এক সমস্যা। নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর বেশির ভাগ সদস্য সাধারণ ক্ষমার অধীনে কাজ করেন। এক্ষেত্রে র‌্যাব’র কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে হত্যাকাণ্ডের ঘটনার তদন্তে সরকার সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়নি। সরকারি দুর্নীতি ও তার সঙ্গে সম্পৃক্ত সাধারণ ক্ষমা অব্যাহত রয়েছে।

নিখোঁজ হওয়া সম্পর্কে বলা হয়, পুরো বছরে যেসব নিখোঁজ ও অপহরণের ঘটনারঅভিযোগ আছে তা ঘটিয়েছে বেশির ভাগই নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা। ২০১১ সাল জুড়ে তা বেড়ে যায়। কিন্তু এর সঠিক সংখ্যা পাওয়া যায়নি। কতগুলো অপহরণ ঘটেছে রাজনৈতিক উদ্দেশে। কিছু অপহরণ ঘটেছে টাকার জন্য। আবার কিছু অপহরণ ঘটেছে স্থানীয় শত্রুতা থেকে। মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা অধিকার-এর মতে, নিরাপত্তা বাহিনী জড়িত এমন অভিযোগ আছে ৩০টি নিখোঁজের ঘটনায়। ২০১০ সালে এই সংখ্যা ছিল ৯। র‌্যাব বলছে, যেসব নিখোঁজের ঘটনায় তাদেরকে দায়ী করা হচ্ছে, সেসব ঘটনা র‌্যাব বা পুলিশ সেজে অন্যরা ঘটিয়েছে। অধিকার উদাহরণ দিয়ে বলেছে, ওই বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি র‌্যাব ঢাকা শহরের উত্তর শাহজাহানপুর থেকে একজন ইমাম ও বিক্রয়কর্মী মোহাম্মদ রফিকুল ইসলামকে আটক করে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন এবং রফিকুলের জামাই পুলিশে গিয়ে অভিযোগ করেছেন যে- র‌্যাব অফিসাররা আটক করেছে রফিকুলকে। তাকে জোর করে একটি কাভার্ড ভ্যানে তুলে নিয়েছে। এ সময় র‌্যাব সদস্যদের কেউ কেউ ছিলেন সাধারণ পোশাকে। কিন্তু র‌্যাব এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। বছর শেষে রফিকুল কোথায় তা অজ্ঞাতই রয়ে যায়। ওদিকে ২০১০ সালের জুনে র‌্যাব সদস্যরা ঢাকা সিটি কমিশনার চৌধুরী আলমকে আটক করে বলে অভিযোগ আছে। কিন্তু ২০১১ সাল শেষ হয়ে গেলেও জানা যায়নি চৌধুরী আলম কোথায় আছেন।

বিচার বিভাগ সম্পর্কে ওই রিপোর্টে অতিমাত্রায় দলীয়করণের কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, আইনে আছে বিচারবিভাগ স্বাধীন। কিন্তু সংবিধানের দীর্ঘদিনের একটি অস্থায়ী বিধানের কারণে নির্বাহীরা নিম্ন আদালতের দায়িত্বপ্রাপ্ত। তারা বিচার বিভাগের নিয়োগ দেন। আইনের মাধ্যমে ২০০৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিচারবিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করা হয়েছে। বছরজুড়েই তা অব্যাহত ছিল। বিচারবিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করা সত্ত্বেও উচ্চ আদালতে নিয়োগ দিয়েছে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব। অভিযোগ আছে, রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর অনেক মামলায় তারা বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেন। এতে সমস্যা বেড়েছে। বিরোধী দলের সদস্যদের ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ সঙ্কুচিত করা হয়েছে।

রাজনৈতিক অধিকারের প্রতি সম্মান: মানবাধিকার রিপোর্টে ২০১১ সালের বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিশদ বর্ণনা রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, সংবিধানে জনগণের ভোটে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবর্তনে অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। গত বছর ৩০ জুন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার সংবিধানে একটি সংশোধনী আনে। ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে বর্তমান সরকারের অধীনেই ২০১৩ সালের নির্বাচন হওয়ার কথা। ওই সংশোধনীতে স্বাধীন ইলেকশন কমিশন প্রতিষ্ঠার কথা বলা হলেও নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এর বিরোধিতা করছে। তারা বলছে, বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা এখনও ভঙ্গুর। যেকোনো রাজনৈতিক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে তা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করার আশঙ্কা রয়েছে। গত বছরজুড়ে সরকার ও বিরোধী দলের মুখোমুখি অবস্থানে আগামী নির্বাচন কোন সরকারের অধীনে হবে তা দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের শীর্ষ বিতর্কিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে বলে রিপোর্টে উলেস্নখ করা হয়েছে।

বিরোধী দলের জাতীয় সংসদ বর্জনের বিষয়ে রিপোর্টে বলা হয়, বিরোধীরা স্পিকার নিরপেক্ষ নয় বলে বারবার অভিযোগ করছে। তারা সংসদের স্থায়ী কমিটিগুলোর কার্যক্রমে বিভিন্নভাবে অংশ নিলেও সংসদ অধিবেশন নিয়মিত হচ্ছেন না।

সরকারের দুর্নীতি প্রসঙ্গ: সরকারি কার্যক্রমের অনিয়ম-দুর্নীতি বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের মানবাধিকার রিপোর্টে। সেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে দুর্নীতিবিরোধী আইন ও বিধিবিধান থাকলেও সরকার তার যথাযথ প্রয়োগ করে না। সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকেই দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এখানে দুর্নীতি করলেও শাস্তি হয় না। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) ‘দন্তহীন বাঘ’ আখ্যা দিয়েছে। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার আগে শাসক দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির যেসব মামলা হয়েছিল কোনো আইন কানুনের তোয়াক্কা না করে নির্বাহী আদেশের বলে তা প্রত্যাহার করা হয়েছে। অথচ খালেদা জিয়া কিংবা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা খুব কম মামলাই প্রত্যাহার করা হয়েছে।

No comments:

Post a Comment