Monday, December 27, 2010

আইবির জরিপঃ কুমিল্লায় সকালে মামলা, সন্ধ্যায় খারিজ

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) শীর্ষস্থানীয় তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গতকাল রোববার সকালে কুমিল্লার আদালতে মামলা করেন এক আইনজীবী। দুপুরে আদালত ওই মামলায় টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান এম হাফিজউদ্দিন খান, নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান ও জ্যেষ্ঠ ফেলো মো. ওয়াহিদ আলমের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। পরে সন্ধ্যায় একই আদালত মামলাটি খারিজ করে দেন।

একই দিন চট্টগ্রামের আদালতেও টিআইবির এই তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেন সেখানকার দুই আইনজীবী। এ দুটি মামলায় টিআইবির তিনজনকে আদালতে হাজির হতে সমন জারি করা হয়।
গতকাল সকালে কুমিল্লার ১ নম্বর আমলি আদালতে টিআইবির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলাটি করেন বিএনপি-সমর্থিত জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের কুমিল্লা জেলা শাখার সদস্য তৌহিদুর রহমান। ৫০১/৫০২/১০৯ ধারায় কুমিল্লার ১ নম্বর আমলি আদালতের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম গাজী সাইদুর রহমান মামলাটি আমলে নেন এবং বিবাদী তিনজনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন।
বাদী তৌহিদুর রহমান গতকাল দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি একজন আইনজীবী হিসেবে ওই মামলা দায়ের করেছি। বিচারক মামলার আরজি দেখে বিবাদীদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন।’
কুমিল্লার সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) মো. মজিবুর রহমানও সন্ধ্যায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির বিষয়টি নিশ্চিত করেন। পরে রাত সাড়ে আটটায় পিপি মজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ফরম (তলবানা) পূরণের কিছু প্রক্রিয়া রয়েছে, যাতে বিবাদীর পূর্ণ ঠিকানাসহ যোগাযোগের আনুষঙ্গিক বিষয়াদি লিখতে হয়। কিন্তু বাদী তা না করায় একই আদালত সন্ধ্যায় মামলাটি খারিজ করে দিয়েছেন।
তবে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের একটি সূত্র জানায়, মামলাটি দায়েরের পর বাদী দলের পক্ষ থেকে চাপে পড়েন।
অবশ্য রাতে যোগাযোগ করা হলে বাদী তৌহিদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি তলবানার ফরম পূরণ না করায় আদালত পরে মামলাটি খারিজ করেছেন।
মামলায় অভিযোগ: মামলার আরজিতে বলা হয়, ২৩ ডিসেম্বর প্রকাশ করা টিআইবির জরিপ সম্পূর্ণ অসত্য, উদ্দেশ্যমূলক এবং অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিক প্রকাশ বটে। জরিপের ফলাফল প্রকাশের দিন ২০০৭ সালে বিচার বিভাগের অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে ২০১০ সালের একটি তুলনামূলক পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয়। ওই পরিসংখ্যানে দুর্নীতির মাত্রা ২০০৭ সালের তুলনায় ২০১০ সালে বেশি দেখানো হয়। টিআইবি উদ্দেশ্যমূলক ও ষড়যন্ত্রমূলকভাবে সদ্য পৃথক হওয়া স্বাধীন বিচার বিভাগকে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করানোর অপপ্রয়াস চালিয়েছে বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়।
মামলার আরজিতে কুমিল্লার সহকারী পাবলিক প্রসিকিউর (এপিপি) আবুল কালাম আজাদসহ ১৩ জন সাক্ষীর নাম উল্লেখ করা হয়।
প্রসঙ্গত, টিআইবি ২৩ ডিসেম্বর ‘সেবা খাতে দুর্নীতি: জাতীয় খানা জরিপ-২০১০’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে সেবা খাতগুলোর মধ্যে বিচার বিভাগের দুর্নীতি সবচেয়ে বেশি বলে উল্লেখ করা হয়।
চট্টগ্রামের দুই মামলা: স্থানীয় আইনজীবী মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ও মোহাম্মদ মুজিবুল হক বাদী হয়ে টিআইবির তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যথাক্রমে চট্টগ্রামে মহানগর হাকিম মোহাম্মদ মাহাবুবুর রহমানের আদালতে ও বিচারিক হাকিম কেশব রায় চৌধুরীর আদালতে পৃথক মামলা দুটি করেন।
তিন বিবাদীকে চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম আদালতে আগামী ১৩ জানুয়ারি এবং চট্টগ্রামের বিচারিক হাকিম আদালতে ৩১ জানুয়ারি হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন উভয় আদালত।
এর মধ্যে চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম মোহাম্মদ মাহাবুবুর রহমান অভিযোগ আমলে নিয়ে বলেন, টিআইবির প্রতিবেদনের একটি অংশে ‘উকিলের হয়রানির শিকার হয়েছেন ৩৯ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ’ বলে উল্লেখ করা হয়। বিচার বিভাগের অন্যান্য বিষয় বিবেচনায় না আনলেও প্রতিবেদনের এ অংশের কারণে একজন আইনজীবী হিসেবে অভিযোগকারী সংক্ষুব্ধ বলে ধরে নেওয়া যায়। সার্বিক বিবেচনায় অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা থাকায় ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৫০০ ও ৫০১ এবং তৎসহ ১০৯ ধারার অধীনে আসামিদের বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে নেওয়া হলো।
অন্য মামলায় চট্টগ্রাম জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম কেশব রায় আদেশে বলেন, ‘অভিযোগ পর্যালোচনায় আসামিদের বিরুদ্ধে ৫০০, ৫০১ এবং ১০৯ ধারা আমলে নেওয়া হলো।’
উভয় মামলার আরজিতে বলা হয়, নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক হওয়ার পর একটি প্রতিক্রিয়াশীল ও স্বার্থান্বেষী মহল বিভিন্নভাবে স্বাধীন বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন ও অকার্যকর করতে তৎপর। আসামিরা এ ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত। আসামিরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে সীমিতসংখ্যক ব্যক্তির শুধু অনুমাননির্ভর অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে কথিত জরিপের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
মহানগর হাকিম আদালতে করা মামলার বাদী মোহাম্মদ মহিউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘টিআইবির প্রতিবেদন গোটা বিচার বিভাগের মর্যাদা প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে। একজন আইনজীবী হিসেবে সমাজে আমাকেও খাটো করা হয়েছে। তাই আদালতের কাছে ফরিয়াদ জানিয়েছি।’
টিআইবির প্রতিক্রিয়া: মামলার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আইনের শাসনে বিশ্বাস করি। আইনি প্রক্রিয়ায় বিষয়টি শেষ করব। আশা করি, ন্যায় বিচার পাব এবং ন্যায় বিচারের মধ্য দিয়ে দেশে যে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে, সেটাও নিশ্চিত হবে। এ ব্যাপারে আমাদের আত্মবিশ্বাস রয়েছে।’
সনাকের নিন্দা: টিআইবির সহযোগী সংগঠন সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) চট্টগ্রাম ও কুমিল্লায় মামলা দায়ের নিন্দা জানিয়েছে। গতকাল সনাকের কুমিল্লা ও লালমনিরহাট শাখার নেতারা বলেন, এটি একটি অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ এবং প্রতিষ্ঠানের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি নগ্ন হস্তক্ষেপ।

No comments:

Post a Comment