Thursday, January 06, 2011

সাফল্য দাবি, ধৈর্য ধরার অনুরোধ

দু'বছরে নানা খাতে সরকারের সাফল্য দাবি করেছেন প্রধানমন্ত্রী। একইসঙ্গে জনকল্যাণমুখী বিভিন্ন কর্মসূচির ফল পেতে দেশবাসিকে ধৈর্য ধরার অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবার বলেছেন, "দেশবাসির কাছে আমার অনুরোধ, আপনারা একটু ধৈর্য ধরুন। আমাদের সহযোগিতা করুন। আমরা আমাদের প্রতিশ্র"তি পূরণ করবই, ইনশাআল্লাহ।"

"গত দুই বছরে জনকল্যাণে আমরা যেসব কর্মসূচি গ্রহণ করেছি, তার সবগুলোর ফল হয়তো এখনই পাওয়া যাবে না। সময়ের পরিক্রমায় দেশবাসি এসব কর্মসূচির ফল দেখতে পাবেন।" আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের দু'বছর পূর্তি উপলক্ষে বৃহস্পতিবার রাতে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে শেখ হাসিনা দেশবাসির কাছে এই আহবান জানান। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে আধ ঘণ্টা ভাষণ দেন তিনি।

যোগাযোগ, আইন-শৃঙ্খলা, শিক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি, দারিদ্র্য বিমোচন, স্বাস্থ্যসেবা, পররাষ্ট্র এবং অর্থনৈতিক খাতে সরকার দুবছরে সাফল্য পেয়েছে বলে দাবি করেন প্রধানমন্ত্রী।

বাধা থাকলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবেন বলে দৃঢ় অঙ্গিকার প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, "জাতির প্রত্যাশা ও আকাক্সক্ষা অনুযায়ী চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব এ বিচার কাজ শুরু হবে।"

একটা চিহ্নিত গোষ্ঠীর বাধা অব্যাহত থাকলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে দেশবাসীর সহযোগিতা চান তিনি। নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করছে বলেও দাবি করেন শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, "দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিচার বিভাগ এখন সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে।" প্রধামন্ত্রী বলেন, "আমাদের সবকিছু শুরু করতে হয়েছে নতুন করে। আমাদের পূর্ববর্তী সরকারগুলো কোন উন্নয়ন কর্মসূচি রেখে যায়নি। বরং শিক্ষার হার, বিদ্যুৎ উৎপাদন, স্বাস্থ্যসেবা সর্বক্ষেত্রে দেশকে পিছিয়ে রেখে গেছে।" মহাজোট সরকার সংসদকে গণতন্ত্র চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে বলে দাবি করেন প্রধানমন্ত্রী।

বিরোধী দলের 'ব্যর্থতায়' প্রধানমন্ত্রী দুঃখিত
বিরোধী দল হিসাবে জাতীয় সংসদে নিজেদের ভূমিকা পালনে বিরোধী দল [বিএনপি] সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে দাবি করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিষয়টি দুঃখের।

তিনি বলেছেন, "দুঃখের বিষয় সংসদে আমাদের প্রধান বিরোধী দল তাদের যথাযথ ভূমিকা পালন করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। তারা জাতীয় সংসদের ১৭৪টি কার্য দিবসের মধ্যে মাত্র ৪৪ কার্য দিবস উপস্থিত ছিল। বিরোধীদলের নেতা মাত্র পাঁচদিন সংসদে উপস্থিত ছিলেন।"

মহাজোট সরকার সংসদকে গণতন্ত্র চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে বলে দাবি করেন শেখ হাসিনা। ১৩০টি আইন পাশসহ নবম জাতীয় সংসদের কর্মকাণ্ড তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করছে বলেও দাবি করেন শেখ হাসিনা।

সরাসরি কারো নাম উল্লেখ না করে শেখ হাসিনা বলেন, "জনগণের সম্পদ লুট করে যারা সম্পদের পাহার গড়ে তুলেছে, যারা জনগণের সম্পদ বিদেশে পাচার করেছে। অতীতের মতো এখনো তারা চেষ্টা করছে দেশের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করতে।"

'চালের দাম বৃদ্ধি তদন্ত হচ্ছে'
ভরা মৌসুমে চালের দাম বাড়ার বিষয়টি তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলেও ভাষণে জানান প্রধানমন্ত্রী। কৃষকের উৎপাদন মূল্য নিশ্চিত করতেই চালের দাম বৃদ্ধি হয়েছে বলে ভাষণে জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, "যে চালের দাম ছিল প্রতি কেজি ৪৫ টাকা, আমাদের বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে তা ১৮-২০ টাকায় নেমে আসে। পরবর্তীতে কৃষকের উৎপাদিত ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে আমরা চালের দাম বাড়িয়ে ২৮ টাকা করি।"

'বিএনপি-জামায়াত জোটের সঙ্গে তুলনা করুন'
মহাজোটের সাফল্য বিচারের ভার জনগণের ওপর ছেড়েছেন শেখ হাসিনা। তবে তিনি তার সরকারের সময়কে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে তুলনা করার অনুরোধ জানিয়েছেন।

জনগণের ভাগ্য উন্নয়নে মহাজোট সরকারের আন্তরিকতার বিষয়টি নিশ্চিত করে শেখ হাসিনা বলেন, "দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে আমি এবং আমার সহকর্মীরা আপ্রাণ চেষ্টা করছি আপনাদের আস্থার প্রতি সম্মান দেখিয়ে সাধারণ মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের।"

বিএনপি নেতৃত্বধানী গত চারদলীয় জোট সরকারের পাঁচ বছর এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরে দেশের সব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ভেঙে পড়েছিলো বলে দাবি করেন সরকারপ্রধান হাসিনা।

'যোগাযোগ আমূল পাল্টেছে, জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় হবে'
মহাজোট সরকারের দুই বছরে যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এসেছে বলে দাবি করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, "রেল সংযোগসহ বহু আকাক্সিক্ষত পদ্মা বহুমূখি সেতুর মূল নির্মাণ কাজ এবং পদ্মা সেতুর উভয় প্রান্তে রেললাইন স্থাপনের কাজও শিগগিরই শুরু হবে।"

ঢাকার যানজট নিরসনে উড়াল সেতু ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ, কমিউটার ট্রেন ও ওয়াটার বাস সার্ভিস চালুর বিষয়টিও শেখ হাসিনা উল্লেখ করেন।

প্রধানমন্ত্রী জানান, প্রতিটি উপজেলায় একটি করে কারিগরি স্কুল হচ্ছে। একই সঙ্গে মাদ্রাসা শিক্ষাকে যুগোপযোগী করা হচ্ছে। প্রতিটি জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হবে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে সকল ছাত্রছাত্রীর মধ্যে বই বিতরণ, পঞ্চম শ্রেণীতে সমাপনী পরীক্ষা, অষ্টম শ্রেণীতে জুনিয়র স্কুল ও দাখিল সার্টিফিকেট পরীক্ষা পদ্ধতি চালুর বিষয়টি উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, "এক হাজার ৬২৪টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এমপিও ভুক্ত করা হয়েছে। শেখ হাসিনা বলেন, ছয়টি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে।" প্রধানমন্ত্রী শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ তুলে ধরতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, "আমরা ইতোমধ্যে ৩০টি মডেল মাদ্রাসা স্থাপন করেছি। ১০০টি মাদ্রাসায় ভোকেশনাল কোর্স খোলা হয়েছে। ৩১টি মাদ্রাসায় অনার্স কোর্স চালু করা হয়েছে।"

বিদ্যুৎ সংকটে বিরোধী দলকেই দুষলেন প্রধানমন্ত্রী
দেশের চলমান বিদ্যুৎ সংকটের জন্য আবারো বিরোধী দলকে দায়ী করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভাষণে তিনি বলেন, "আজকে দেশব্যাপী বিদ্যুৎ-জ্বালানির যে তীব্র সঙ্কট, তার মূলে রয়েছে বিএনপি-জামাত জোট সরকারের চরম ব্যর্থতা এবং এখাতে ব্যাপক লুটপাট দুর্নীতি। তবে আমরা কঠোর পরিশ্রম করে সংকট কাটিয়ে উঠছি।"

চারদলীয় জোট সরকারের পাঁচ বছর 'এক মেগাওয়াট বিদ্যুতও উৎপাদিত হয়নি' দাবি করে তিনি বলেন, "কিন্তু লুটপাট হয়েছে হাজার কোটি টাকা।" ৩৩টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ কাজ শুরু কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, "এতে ২ হাজার ৯৪১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে।"

৩ হাজার ৮৪০ মেগাওয়াট ক্ষমতা-সম্পন্ন আরো ২৪টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য দরপত্র আহ্বানের কথাও বলেন তিনি। আগামী পাঁচ বছরে প্রায় ১২ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের কর্মসূচি নেওয়ার কথাও প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে বলেন।

তিনি বলেন, "গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি আমরা তরল জ্বালানি, কয়লা, ডুয়েল ফুয়েল এবং নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজ শুরু করেছি।" রাশিয়ার সহযোগিতায় রূপপুরে একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরুর বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, "এখানে পর্যায়ক্রমে দু'হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে।"

"২০১২ সালের মধ্যে ভারত থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে," বলেন প্রধানমন্ত্রী। বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, বিনামূল্যে এক কোটি পাঁচ লাখ বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী সিএফএল বাল্ব বিতরণ করা হয়েছে। আরো এক কোটি ৭৫ লাখ বিতরণ করা
হবে।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত অর্থনৈতিক, খাদ্য, শিক্ষা ও বিদ্যুত খাতে সফলতার চিত্র তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, সে সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন ১৬০০ মেগাওয়াট থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৪৩০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছিল।

'পাটের জন্মরহস্য আবিষ্কার সবচেয়ে বড় সাফল্য'
পাটের জন্ম রহস্য আবিষ্কার মহাজোট সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্য বলে দাবি করে প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, "আমাদের সবচেয়ে বড় সাফল্য পাটের জেনোম সিকোয়েন্স বা জন্ম রহস্য আবিষ্কার। এ আবিষ্কারের ফলে আমরা পাটের উন্নত জাত উদ্ভাবন এবং বহুবিধ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারব। তিনি আরো বলেন, "আমরা পাট শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করেছি। পাটের মণ প্রতি দাম ২ থেকে আড়াই হাজার টাকা।"

'গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে নির্বাচিত হয় মহাজোট'
ভাষণের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে মহাজোট সরকার গঠন করেছে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট জয়লাভ করে। পরের বছরের ৬ জানুয়ারি তারা সরকার গঠন করে। সরকার পরিচালনায় সহযোগিতা করার জন্য দেশবাসিকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী।

No comments:

Post a Comment