Sunday, September 25, 2011

কয়লা নিয়ে পথ খুঁজে পাচ্ছে না সরকার by অরুণ কর্মকার

বাণিজ্যিক জ্বালানি হিসেবে কয়লার ব্যবহার বাড়ানোর পথ পাচ্ছে না সরকার। বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লার বিপুল ব্যবহার পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু দেশীয় কয়লা উত্তোলন কিংবা বিদেশ থেকে আমদানির উদ্যোগ এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে।

এ অবস্থায় সরকার কয়লানীতি চূড়ান্ত করার জন্য আবার নতুন একটি কমিটি গঠন করেছে। পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেনকে আহ্বায়ক করে গঠিত ১৫ সদস্যের এ কমিটি বর্তমান সরকারের সময়ে গঠিত দ্বিতীয় কমিটি।
গত বছর এপ্রিল মাসে জ্বালানিসচিব মোহাম্মদ মেজবাহউদ্দিনকে প্রধান করে গঠিত কমিটিকে কয়লানীতি চূড়ান্ত করার জন্য যে কার্যপরিধি দেওয়া হয়েছিল, নতুন গঠিত কমিটিকেও একই কার্যপরিধি দেওয়া হয়েছে। নতুন কমিটিকে আগামী চার মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
যদিও আগের কমিটির চূড়ান্ত করা নীতিটি সম্পর্কে মতামত নেওয়ার জন্য গত বছরের ২৪ অক্টোবর ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। পাওয়া মতামতের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি চূড়ান্তও করা হয়। তখন থেকে বর্তমান কমিটি গঠনের আগে পর্যন্ত বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী, সচিব এবং প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী একাধিকবার বিভিন্ন স্থানে বলেছেন যে চূড়ান্ত কয়লানীতি শিগগিরই প্রকাশ করা হবে।
এরপর আবার কমিটি গঠনের প্রয়োজনীয়তা কী, জানতে চাইলে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের নির্ভরযোগ্য সূত্র প্রথম আলোকে বলেন, সরকার আসলে কী করবে বুঝতে পারছে না। সে জন্যই একই কার্যপরিধি দিয়ে আবার কমিটি গঠন করে কিছু সময় নেওয়া হচ্ছে।
শুরুর কথা: কয়লানীতি প্রণয়নের কাজ প্রথম শুরু করা হয় ২০০৬ সালে। তখন একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা হয়েছিল। তাদের খসড়াটি আটবার সংশোধন করার পর বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে চূড়ান্ত করার জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়।
প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক উপাচার্য আবদুল মতিন পাটোয়ারিকে প্রধান করে গঠিত ওই কমিটি খসড়া নীতির প্রতিটি লাইন ধরে আলোচনা করে একটি চূড়ান্ত খসড়া তৈরি করে সরকারকে দেয়। সরকারি পর্যায়েও কিছু কাজ করে সেটি চূড়ান্ত করা হয়। অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এ ধরনের একটি জাতীয় নীতি চূড়ান্ত করতে পারে না বলে সুশীল সমাজের একাংশ দাবি জানালে নীতিটি ওই অবস্থাতেই রেখে দেওয়া হয়।
নীতির মৌলিক বিষয়: সেই কয়লানীতির খসড়ার মৌলিক বিষয় ছিল—কয়লা তোলার পদ্ধতি নির্ধারিত হবে প্রতিটি খনির ভূ-তাত্ত্বিক, পরিবেশ-প্রতিবেশ ও খানা এলাকার সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে। কয়লা রপ্তানি করা যাবে না, উত্তোলন করা হবে জাতীয় চাহিদা অনুযায়ী। কয়লা উত্তোলন হবে সরকারি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব ও ব্যবস্থাপনায়। প্রয়োজনে তারা দেশের আইনকানুন অনুযায়ী সহযোগী হিসেবে কোনো দেশি বা বিদেশি কোম্পানিকে সঙ্গে নিতে পারবে। রয়্যালিটি নির্ধারণের প্রয়োজন হলে তা হবে বিভিন্ন দেশের হার পর্যালোচনা করে তার ভিত্তিতে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে। খনির জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হলে ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন করতে হবে আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী। খনি এলাকার লোকদের যোগ্যতা অনুযায়ী খনির কাজে নিয়োগে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
এ ছাড়া বিশেষজ্ঞ কমিটির একটি সুপারিশ ছিল, খনির জন্য যাঁদের জমি অধিগ্রহণ করা হবে, ৩০ বছর পর ওই জমি পুনরুদ্ধার করে তাঁদের ফিরিয়ে দিতে হবে। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এ বিষয়টিতে একমত হয়নি।
বর্তমান সরকারের উদ্যোগ: বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের ১২ এপ্রিল অর্থমন্ত্রী আবুল মাল অবদুল মুহিত এক চিঠিতে জ্বালানি মন্ত্রণালয়কে কয়লানীতি চূড়ান্ত করতে বলেন। চিঠিতে চূড়ান্ত কয়লানীতিতে অন্তত ২৫ বছর কোনো কয়লা রপ্তানি না করার বিধান রাখতে বলা হয়। চিঠি পাওয়ার পর ২১ এপ্রিল জ্বালানি সচিবকে প্রধান করে কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির প্রতিবেদন ওয়েবসাইটে প্রকাশ এবং চূড়ান্ত করার পর আবার ৮ সেপ্টেম্বর নতুন কমিটি করা হলো।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লা: বিদ্যুৎ খাত মহাপরিকল্পনায় (২০৩০ সাল পর্যন্ত) বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি বহুমুখীকরণের নীতি নেওয়া হয়েছে। এর অংশ হিসেবে ১৫ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। অথচ খনি থেকে কয়লা উত্তোলন বাড়ানোর কোনো কার্যকর উদ্যোগ সরকার এখন পর্যন্ত নিতে পারেনি।
বর্তমানে দেশের একমাত্র কয়লাখনি বড়পুকুরিয়া থেকে বছরে সাত থেকে আট লাখ টন কয়লা তোলা যাচ্ছে, যার অধিকাংশ ব্যবহূত হচ্ছে সেখানকার ২৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালাতে।
এ অবস্থায় সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কয়লা আমদানির উদ্যোগ নেয়। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় বাংলাদেশে অবস্থিত আটটি দেশের দূতাবাসে প্রায় ছয় মাস আগে চিঠি পাঠায়। তবে এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনো খবর পাওয়া যায়নি বলে সরকারি সূত্র জানায়।
কয়লার মজুদ: এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত দেশের পাঁচটি কয়লাক্ষেত্রে মোট মজুদের পরিমাণ প্রায় ৩০০ কোটি টন। এর সবই উন্নতমানের বিটুমিনাস কয়লা। এর মধ্যে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে উত্তোলনযোগ্য প্রায় ১৮০ কোটি টন। এ কয়লা দিয়ে ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় ৫০ বছর ধরে। তবে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে খনির কাজ শুরুর আগেই জনবসতি স্থানান্তর, কৃষিজমি হারানো ও পরিবেশ-প্রতিবেশগত অনেক সমস্যার সমাধান করতে হবে।
ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে উত্তোলন করলে কয়লা তোলা সম্ভব হবে সর্বোচ্চ ৪০ কোটি টন। বাকি কয়লা মাটির নিচেই থেকে যাবে। এ পদ্ধতিতে ভূমিধসের আশঙ্কা থাকে। তবে তা হবে খনি থেকে কয়লা তোলা শুরু করার পরে।
নির্বাচনী অঙ্গীকার: আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছে, ‘এযাবৎ প্রাপ্ত কয়লার অর্থনৈতিক ব্যবহার এবং কয়লাভিত্তিক শিল্প নির্মাণে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হবে। নতুন কয়লা ও অন্যান্য খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে।’

No comments:

Post a Comment