Sunday, September 25, 2011

তিতাসের সাড়ে ৯০০ কোটি টাকা 'নাই' by আরিফুজ্জামান তুহিন

রকারি গ্যাস বিতরণ কম্পানি তিতাসের ব্রাহ্মণবাড়িয়া-আশুগঞ্জ এলাকা আরেক সরকারি প্রতিষ্ঠান বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কম্পানির কাছে বিক্রি হয়ে গেছে। এই বিক্রি-প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তিতাসের প্রায় সাড়ে ৯০০ কোটি টাকা 'নাই' হয়ে গেছে। তিতাসের অডিট করা হিসাব বাদ রেখে পেট্রোবাংলা নিজেরা অডিট করে ওই সম্পদের মূল্য প্রায় হাজার কোটি টাকা কম দেখিয়ে বিক্রি করে দিয়েছে। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আশঙ্কা করছেন, পরবর্তী সময়ে বাখরাবাদকে কম টাকায় বেসরকারি খাতে বেচে দেওয়া এবং পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ ফাঁকি দেওয়ার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জ্বালানি মন্ত্রণালয় ও পেট্রোবাংলার নির্দেশেই এটা করা হয়েছে।

জানা গেছে, তিতাসের ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও আশুগঞ্জ এলাকাটি বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কম্পানির কাছে ২৬৮ কোটি ২০ লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়। অথচ তিতাসের নিয়োজিত অডিট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এলাকাটির মূল্য এক হাজার ২০৭ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। সেই হিসাবে ৯৩৯ কোটি ২৫ লাখ টাকার কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান হোসেন মনসুর কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এগুলো হলো পেট্রোবাংলার অধীন কম্পানি। তিতাস তাদের নিয়োজিত অডিট ফার্ম দিয়ে নিজেদের মতো হিসাব করে অঞ্চলটির মূল্য অনেক বেশি দেখায়। তিতাসের হিসাব ও বাখরাবাদের হিসাব দুই রকম হওয়ায় পেট্রোবাংলা আরেকটি কম্পানিকে দিয়ে অডিট করিয়ে মন্ত্রণালয়কে বিক্রির সুপারিশ করে।' তিনি বলেন, তিতাসের এ অঞ্চলটি হস্তান্তরও হয়ে গেছে। তিতাসের বোর্ড সভার সিদ্ধান্ত বাতিল না করে কেন পেট্রোবাংলা এ রকম সিদ্ধান্ত নিল_এমন প্রশ্নের জবাবে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, 'দীর্ঘদিন বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বাংলাদেশের জ্বালানি খাত বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার জন্য সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে আসছে। সেই চাপেরই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে এখানে। তিতাস একটি লাভজনক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, এই প্রতিষ্ঠানকে হুট করে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া যায় না। তাই ধীরে ধীরে তারা এভাবে বাস্তবায়ন করছে।' তিনি আরো বলেন, 'কম দাম দেখিয়ে তিতাসের ব্রাহ্মণবাড়িয়া-আশুগঞ্জ এলাকা ছেড়ে দেওয়া হলো, এর কারণ পরবর্তী সময়ে বাখরাবাদ যখন বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হবে, তখন এই
প্রতিষ্ঠানের মূল্য যেন কম দেখানো যায়। বেসরকারীকরণ হলে তা বিদেশি বহুজাতিক কম্পানির হাতে চলে যাবে। এর ভাগ স্থানীয় কিছু দালাল লুটেরাও পাবে। জ্বালানি খাত বিদেশি বহুজাতিক কম্পানি দখলের যে চেষ্টা করছে, এটা সেই ষড়যন্ত্রেরই অংশ।'
তিতাস সূত্রও জানায়, বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কম্পানি বেসরকারি খাতে ছাড়ার চক্রান্ত চলছে। এদের সহায়তায় বাখরাবাদ চলে যাবে ব্যবসায়ীদের হাতে। তিতাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হস্তান্তর শেষ হয়েছে, এখন খুব শিগগির পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হবে বাখরাবাদ। পুঁজিবাজারে বাখরাবাদের তালিকাভুক্ত হওয়ার বিষয়টি মন্ত্রণালয়ে অনুমোদিত হয়ে আছে। তিতাসের শেয়ারহোল্ডারদের আর্থিকভাবে ঠকানোর জন্যই মূল্য কম দেখানো হয়েছে বলে সূত্র অভিযোগ তুলেছে।
সূত্রে জানা যায়, তিতাস মেসার্স আহমেদ অ্যান্ড আকতার নামের একটি ফার্ম দিয়ে অডিট করায়। তারা তিতাসের এ এলাকাটির মূল্য এক হাজার ২০৭ কোটি ৪৫ লাখ এক হাজার ৬৫৪ টাকা বলে প্রতিবেদন দেয়। প্রতিবেদনটি গত বছরের ১৯ অক্টোবর তিতাসের ৬১৩তম সভায় অনুমোদনও করা হয়। ওই সভায় সিদ্ধান্ত হয়, বাখরাবাদ শতকরা ২০ ভাগ টাকা এককালীন (ডাউন পেমেন্ট) দেবে, বাকিটা ১৫ বছরের কিস্তিতে পরিশোধ করবে। ২৫ অক্টোবর এই সিদ্ধান্ত পেট্রোবাংলাকে জানিয়ে দেয় তিতাস কর্তৃপক্ষ। একই সঙ্গে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশন (এসইসি), ডিএসই ও সিএসইকেও জানানো হয়। তিতাসের এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না করে নতুন করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-আশুগঞ্জ অঞ্চলটি অডিট করায় পেট্রোবাংলা। তাদের মনোনীত অডিট ফার্ম হোদা ভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কম্পানি তিতাসের ওই অঞ্চলটির মূল্য নির্ধারণ করে ২৬৮ কোটি ২০ লাখ টাকা। চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি পেট্রোবাংলার ৪১৭তম বোর্ড সভায় তা অনুমোদনও করা হয়।
তিতাসের বোর্ড সভায় পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানও সদস্য। পেট্রোবাংলার এই সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে মো. আলাউদ্দিন ও মো. সাঈদ নামের তিতাস গ্যাসের দুজন শেয়ারহোল্ডার হাইকোর্টে একটি রিট মামলা (নং-৫৮১৭/২০১১) করেন। রিট আবেদনটি উচ্চ আদালত খারিজ করে দেন। রিট আবেদনকারীরা তখন খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেন।
রিট আবেদনকারীর আইনজীবী মো. নুরুল ইসলাম চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'মামলাটি বর্তমানে চূড়ান্ত শুনানির অপেক্ষায় আছে। আদালত খুললে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পাওয়া যাবে।'
পেট্রোবাংলার কাছে তিতাসের অডিট প্রতিবেদনের চিঠি পাঠানোর প্রায় পাঁচ মাস পর গত ২৪ মার্চ পেট্রোবাংলা তিতাসকে চিঠি দিয়ে এলাকাটির নতুন মূল্যের বিষয়টি অবহিত করে। পেট্রোবাংলার মনোনীত হোদা ভাসি অডিট ফার্মের প্রতিবেদনটি গত ২০ মে তিতাসের বোর্ড সভায় 'বাস্তবতাবর্জিত' বলে মত দেন কম্পানির পরিচালকরা। সরকার ও সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হন সে জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও আশুগঞ্জ প্রকল্পের উপযুক্ত মূল্য নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ওই সভায়। এ কারণে পরবর্তী সময়ে আরো আলোচনা করার সুপারিশও করা হয়।
জানা যায়, তিতাসের পরিচালনা বোর্ডের কাছে হোদা ভাসির করা অডিট প্রতিবেদনের হিসাবে বেশ গরমিল ধরা পড়ে। পেট্রোবাংলার অডিটে মেনটেইনেবল প্রফিট পদ্ধতিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-আশুগঞ্জ এলাকার ভবিষ্যৎ রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে শতকরা মাত্র ২ ভাগ। অথচ তিতাসের ২০০৮-০৯, ২০০৯-১০ এবং ২০১০-১১ অর্থবছরে ওই এলাকার রাজস্ব প্রবৃদ্ধি যথাক্রমে ১৩.৪৯, ১৭.১৭ ও ১২.৪৬ শতাংশ। পেট্রোবাংলার অডিটে ওই এলাকায় গ্যাসস্বল্পতার কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে তিতাস কর্তৃপক্ষের দাবি ব্রাহ্মণবাড়িয়া-আশুগঞ্জ এলাকায় কোনো গ্যাসস্বল্পতা নেই।
তিতাস বোর্ড সূত্রে জানা যায়, হোদা ভাসির করা অডিট প্রতিবেদনে ডিসকাউন্ট ক্যাশ ফ্লো (ডিসিএফ) পদ্ধতিতে ২০১০-১১ অর্থবছরে এলাকাগুলোর আর্নিং বিফোর ইন্টারেস্ট অ্যান্ড ট্যাঙ্সে (ইবিআইটি) ধরা হয়েছে ৩৯২ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। এটা আগের বছরের তুলনায় শতকরা ৫৩ দশমিক ৫৬ ভাগ কম। অথচ এর আগের বছরে এ ক্ষেত্রে আয় ছিল ৯০৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা।
তিতাসের দাবি, এ হিসাব নিরীক্ষণের কোনো আইনি এখতিয়ার নেই পেট্রোবাংলার। কেননা তিতাস পেট্রোবাংলার অধীন কম্পানি হলেও তারা একটি স্বতন্ত্র কম্পানি। শুধু এই দুটি প্রকল্পের দাম কম দেখাতেই পেট্রোবাংলা নিজেদের মতো অডিট করিয়েছে বলে তিতাসের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অভিযোগ করেন।
এত কিছুর পরও তিতাসের ৬৩০তম বোর্ড সভায় হোদা ভাসির অডিট প্রতিবেদনটির অনুমোদন দেওয়া হয়। তিতাসের বোর্ড সভার এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'তিতাস বাধ্য হয়েই অনুমোদন দিয়েছে। এর পেছনে মন্ত্রণালয় ও পেট্রোবাংলার বড় ধরনের চাপ ছিল।'
অন্যদিকে যে কম্পানি তিতাসের এলাকাটি কিনে নিচ্ছে সেই বাখরাবাদ কোনো অডিট করেনি। নিয়মানুযায়ী বাখরাবাদেরও অডিট করার কথা। তিতাস পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কম্পানি হওয়ায় হিসাবটি এসইসি, ডিএসই ও সিএসইরও মূল্যায়ন করার কথা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে এসইসির নির্বাহী পরিচালক এ টি এম তারিকুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এ ব্যাপারে কোনো কাগজপত্র আমাদের কাছে আসেনি। তাই আমরা কিছু বলতে পারছি না।' তবে এসইসির একটি সূত্র দাবি করে, এটি একটি খারাপ নজির।
তিতাসের জনসংযোগ কর্মকর্তা সূত্রে জানা যায়, তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুল আজিজ খান স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য ভারতে অবস্থান করছেন। তাঁর ফিরতে দেরি হবে। তিতাসের ভারপ্রাপ্ত এমডি ও পেট্রোবাংলার প্রশাসন বিভাগের পরিচালক মো. রফিকুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে 'তিনি গণমাধ্যমের সঙ্গে কোনো কথা বলবেন না'_এ কথা তাঁর অধীন কর্মকর্তাদের বলে দিয়েছেন বলে অফিস সূত্রে জানা যায়।

No comments:

Post a Comment