Saturday, January 15, 2011

দার্শনিক-শিক্ষক অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আজরফ

সিলেট শহরে হজরত শাহজালালের মাজারের পাশে অবস্থিত অতি প্রাচীন একটি প্রতিষ্ঠান। তার নাম কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ। এর নাম শুনে নাই, সিলেটে এমন কাউকে হয়ত খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু আসাম-বাংলা অঞ্চলে ইতিহাস, সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চায় এর অবদান ও গুরুত্ব অনেকেরই অজনা।

কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ, তার গ্রন্থাগার এবং তার সাহিত্য পত্রিকা-আল ইসলাহ্ সিলেটের অমূল্য সম্পদ। ম্যাট্রিক পাস করে ১৯৬৯ সালে যখন সিলেট মুরারী চাঁদ উচ্চমাধ্যমিক কলেজে ভর্তি হই, তখন আমিও এর গুরুত্ব জানতাম না এবং বুঝতাম না। ইংরেজীর ক্লাসে, একদিন আমাদের প্রিয় শিক্ষক অধ্যাপক আব্দুস সেলিম বলেছিলেন, "সিলেট শুড বি প্রাউড অফ ইটস্ কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ, ইটস্ লাইব্রেরী এন্ড আল ইসলাহ্"। তারপর বুঝতে শুরু করি সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের গুরুত্ব, মর্যাদা, ও অবদান। আজও দেশ বিদেশের অনেক ইতিহাস, সাহিত্য, ও সংস্কৃতিপ্রেমী গবেষক সিলেটে ছুটে আসেন কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ গ্রন্থাগারে লেখাপড়া ও গবেষণা করার জন্য। কারণ এখানে অনেক পুরনো ও দুর্লভ বইপুস্তক সযত্নে রক্ষিত আছে, যা দেশের অন্য কোথাও নেই। তবে এই নিবন্ধের বিষয়বস্তু সিলেটের কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ নয়, বরং তারই একজন নিবেদিতপ্রাণ প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ আজরফ।

অধ্যক্ষ আজরফ নামে পরিচিত হলেও, তাঁর পুরো নাম দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ। বৃহত্তর সিলেটের সুনামগঞ্জ জেলার তেঘরিয়া গ্রামে নানার বাড়িতে দেওয়ান আজরফের জন্ম হয় ১৯০৮ সালেরা জানুয়ারি। প্রাথমিক লেখাপড়াশেষে তিনি ভর্তি হন দোহালিয়া মাধ্যমিক ইংলিশ স্কুলে। এ্যন্ট্রন্সে পাস করে ১৯২৬ সালে আসেন সিলেট মুরারী চাঁদ কলেজে। সেখান থেকে ডিস্টিংশনসহ বিএ পাস করেন ১৯৩০ সালে। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনশাস্ত্রে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৩২ সালে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে দেওয়ান আজরফ অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তবে 'বইএর পোকা' বলতে যা বুঝায়, তিনি কখনোই তা ছিলেন না। ছাত্র অবস্থায়, পাঠ্য পুস্তকের বাইরের জগতের সাথে তাঁর কর্মতৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মত।

তিরিশের দশকে আসাম-বাংলায় শিক্ষিত মুসলমান যুবক ছিল হীরা জহরতের মতই দুর্লভ। ভাল রেজাল্ট নিয়ে এমএ পাস করে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ পছন্দমত যেকোন পেশা বেছে নিতে পারতেন। কিন্তু অল্প বেতন ও কম সুযোগ সুবিধা জেনেও, আদর্শবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি শুরু করেন কলেজে অধ্যাপনা। তারই এক পর্যায়ে, তিনি সুনামগঞ্জ কলেজে যোগ দেন ১৯৪৮ সালে এবং কলেজের অধ্যক্ষ হিসাবে দায়িত্ব নেন ১৯৫৪ সালে। কিন্তু এ পদে তিনি এক বছরও থাকতে পারেন নি। ১৯৫২'র ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখার জন্য কিছুদিনের মধ্যেই তাঁকে কলেজের অধ্যক্ষ পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। পরে তিনি দেশের বিভিন্ন কলেজে চাকরি করেন। ১৯৬৭ সালে ঢাকায় স্থাপিত হয় আবুজর গিফারী কলেজ। এই নতুন কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ হিসাবে প্রতিষ্ঠানটিকে গড়ে তোলার গুরু দায়িত্ব পড়ে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের ওপর। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম আর সুযোগ্য নেতৃত্বে, আবুজর গিফারী কলেজ অল্পদিনেই একটি প্রথম শ্রেণীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত এক নাগাড়ে তিনি এই কলেজের দায়িত্বে ছিলেন। আবুজর গিফারী কলেজের অধ্যক্ষ থাকা অবস্থায় দেওয়ান আজরফ ১৯৭৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত একসাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন এবং ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে পড়িয়েছেন। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে একজন জাতীয় অধ্যাপকের মর্যাদায় ভূষিত করে।

দর্শনশাস্ত্রের শিক্ষায় ও গবেষণায় অধ্যক্ষ আজরফ ছিলেন এক নিবেদিত প্রাণ পুরুষ। তিনি পাকিস্তান ফিলোসফিক্যাল কংগ্রেসের সক্রিয় সদস্য ছিলেন এবং দীর্ঘদিন ওই প্রতিষ্ঠানের কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর, ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ ফিলোসফিক্যাল সমিতির সভাপতি ছিলেন।

শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অবদানের জন্য তিনি অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। তারমধ্যে উলেস্নখযোগ্য হল - স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার, আন্তর্জাতিক মুসলিম সংহতি পুরস্কার, একুশে পদক, ইসলামী ফাউন্ডেশন পুরস্কার, শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্কর পুরস্কার, বাংলাদেশ মুসলিম মিশন পুরস্কার ইত্যাদি। ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ একজন মিতভাষী, হূদয়বান ও ধার্মিক মানুষ ব্যক্তি ছিলেন। দীর্ঘ ও বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের শেষে ৯১ বছর বয়সে ১৯৯৯ সালে এই মহান শিক্ষাবিদ, দার্শনিক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ ও লেখকের জীবনাবসান ঘটে।

No comments:

Post a Comment