Saturday, January 15, 2011

স্বপ্ন ছিনতাই! রফিক অটোভ্যান থেকে উদ্ভাবক রফিককে বিতাড়নের চেষ্টা গ্রামীণ ফান্ডের

রিদ্র ঘরের, লেখাপড়া না-জানা ছেলে রফিকুল ইসলাম ছোটকাল থেকেই অত্যন্ত মেধাবী। যন্ত্রপাতি নিয়ে খুটখাট করা ছিল তাঁর শখ। আর পেটের তাগিদে চালাতেন রিকশাভ্যান। এই করতে করতে একদিন কিশোর বয়সেই তিনি শ্যালো পাম্প মেশিন দিয়ে রিকশাভ্যান থেকে বানিয়ে ফেলেন অটোভ্যান, যা দেখে সবাই অবাক।

একসময় রফিক এই অটোভ্যান বাণিজ্যিকভাবে বানিয়ে নিজের দিনবদলের পালা শুরু করেন। বগুড়ার শেরপুরে তাঁর গ্রামের বাড়ি থেকে ধীরে ধীরে এই অটোভ্যান ভটভটি, নসিমন, করিমন_বিভিন্ন নামে ছড়িয়ে পড়ে উত্তরবঙ্গের পথে পথে। পরে রফিক তাঁর উদ্ভাবিত এই অটোভ্যানকে ফোরস্ট্রোক ইঞ্জিন দিয়ে, আরো কিছু কারিগরি করে সরকার থেকে 'পরিবেশবান্ধব' ছাড়পত্র নিয়ে খেজুরতলায় নিজের বাড়িতে গড়ে তোলেন একটি কারখানা_'মেসার্স রফিক অটোভ্যান ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রিজ'।
মেধাবী রফিকের এই সাফল্যগাথা ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। পত্রপত্রিকায় লেখা হয় তাঁকে নিয়ে। স্বপ্নরা ভিড় করে রফিকের মনে। একদিন এই স্বপ্নে রং লাগাতে চলে আসে
গ্রামীণ ব্যাংকের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান 'গ্রামীণ ফান্ড'। রফিককে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজি করায় যৌথভাবে এগোনোর। রফিক-গ্রামীণ ফান্ড চুক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা হয় 'রফিক অটোভ্যান ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড'। আর এর পর থেকেই শুরু হয় রফিকের উন্নতির বদলে দুর্গতি। রফিকের সব স্বপ্ন ছিনতাই হয়ে যায় গ্রামীণ ফান্ডের কৌশলী তৎপরতার ফাঁদে। স্বপ্নরঙিন রফিক এখন অসহায়, জর্জরিত, দিশেহারা। ভেবে পান না তিনি, কেমন করে, কোথা থেকে, কী হতে কী হয়ে গেল তাঁর সহজ-সরল জীবনে!
রফিকের সেই দিনগুলি : রফিকের বড় ভাইয়েরা ছিলেন দিনমজুর ও ঠেলাগাড়িচালক। রফিকও কখনো ঠেলাগাড়ি, কখনো রিকশাভ্যান চালাতেন। বড় ভাইয়েরা একসময় পুরনো শ্যালো পাম্প মেশিন কিনে তা আবার বিক্রি করার ব্যবসা শুরু করেন। কিশোর রফিকের ভ্যানেও এসব শ্যালো মেশিন তুলে দেওয়া হতো। রফিক এগুলো দেখতেন আর ভাবতেন, কেমন করে ভ্যান চালানোর পরিশ্রম কমানো যায়।
রফিক সাধনা চালাতে থাকেন। ১৯৮৬ সালের একদিন বানিয়ে ফেলেন সেই যন্ত্রচালিত ভ্যান, ছয় হর্স পাওয়ারের শ্যালো মেশিন যার ইঞ্জিন, একসময় যার নাম হয়ে যায় 'রফিক অটোভ্যান'। একের পর এক অটোভ্যান বিক্রি করে তিনি ২৬ শতাংশ জমি কিনে পাকা বাড়ি তৈরি করেন গ্রামে।
আসে গ্রামীণ ফান্ড : রফিকের সাফল্যের কাহিনী জেনে ঢাকা থেকে যান গ্রামীণ ফান্ড, ইসলামী ব্যাংকসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা। রফিককে সহযোগিতা করার আশ্বাস দেন তারা। রফিক ইতিমধ্যে সেরে ফেলেন গাড়ি তৈরির সব ধরনের আইনি বিষয়। অনেক ভেবেচিন্তে রফিক গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন।
কালের কণ্ঠকে রফিক বলেন, 'ড. ইউনূসকে আমি খুব শ্রদ্ধার চোখে দেখতাম, তাই তাঁর প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেই কাজ করার সিদ্ধান্ত নিই। তারাও আমাকে নানা স্বপ্ন দেখায়। বিপুল আশায় বুক বেঁধে, চোখ-কান বুজে ঝাঁপিয়ে পড়ি কাজে। আমি লেখাপড়া জানি না, ইংরেজিতে লেখা চুক্তিপত্রের কিছুই আমি বুঝতাম না। তাই সরল বিশ্বাসে, ওরা যে কাগজ দিয়েছে, সই দিয়ে গেছি সবখানে।'
রফিক জানান, তিনি শুধু জানতেন এই কারখানা তাঁর নামে। এখানে তাঁর শেয়ার ৬০ শতাংশ আর গ্রামীণ ফান্ডের ৪০ শতাংশ। পরে তিনি প্রকৌশলী হাসান রেজাকে ২৪ শতাংশ শেয়ার দিয়ে তাঁর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন যে প্রকৌশলী এই অটোভ্যানের নকশার কারিগরি উন্নয়নে কাজ করবেন।
গ্রামীণ ফান্ডের সঙ্গে চুক্তির পর রফিক অটোভ্যানকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় প্রথমে ৫০টি, পরে আবার পাঁচ হাজার গাড়ি তৈরির অনুমতি দেয়। তবে এই গাড়ির অনুমোদন নেওয়া হয় 'গ্রামবাংলা অটোভ্যান' নামে। এ প্রকল্পের উদ্বোধন করেন তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মুহাম্মদ ইউনূস উপস্থিত থেকে বক্তব্য দেন।
চুক্তির পর থেকেই বিপদ : গ্রামীণ ফান্ডের সঙ্গে চুক্তির পরই রফিকের জীবনের চাকা অচল হতে থাকে। খেজুরতলার কারখানায় একসময় বছরে ৪৪০টি গাড়ি তৈরি হতো। আর চুক্তির এক বছরের মাথায়ই উৎপাদনের হার কমে যায়। এখন রফিকের অভিযোগ, অনেকটা ষড়যন্ত্র করে, তাঁর উদ্ভাবন ছিনতাই করতেই কারখানার কার্যক্রম স্তিমিত করা হয়। একই সঙ্গে তাঁকেও অনেকটা একঘরে করে রাখা হয়। কম্পানির বোর্ড সভায় তাঁকে ডাকা হয় না। তাঁর কোনো প্রস্তাবও মানা হয় না।
চুক্তিপত্রেই খাটো রফিক : গ্রামীণ ফান্ডের সঙ্গে রফিক চুক্তিতে আবদ্ধ হন ২০০২ সালের ৬ মার্চ। যৌথভাবে ব্যবসা করার জন্য অংশীদারি চুক্তি হয়। চুক্তিতে গ্রামীণ ফান্ডের পক্ষে কর্মকর্তা এ এ কোরেশী, রফিক অটোভ্যান ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রিজের পক্ষে রফিকুল ইসলাম ও প্রকৌশলী হাসান রেজা স্বাক্ষর করেন। তিন চাকার পরিবেশবান্ধব অটোভ্যান প্রস্তুত এবং বাজারজাত একসঙ্গে পরিচালনার জন্য এই চুক্তি হয় ইংরেজিতে। অটোভ্যানের উদ্ভাবক রফিক একজন অশিক্ষিত ব্যক্তি। তাঁর সঙ্গে ইংরেজিতে চুক্তিপত্র সম্পাদন করাটাই শুভঙ্করের ফাঁকি। আইনজীবীদের মতে, চুক্তিপত্র যেকোনো ভাষায় হতে পারে, তবে অবশ্যই তা হতে হবে সহজবোধ্য। দেওয়ানি ও চুক্তি আইনের মামলায় অভিজ্ঞ আইনজীবী রাজীব কুমার চক্রবর্তী কালের কণ্ঠকে বলেন, চুক্তিপত্রের নিচে লেখা থাকে, 'আমরা চুক্তিপত্র পড়িয়া, বুঝিয়া, সজ্ঞানে-সুস্থ মস্তিষ্কে চুক্তিনামায় স্বাক্ষর করিলাম।' কাজেই চুক্তি অবশ্যই সহজবোধ্য হতে হবে।
গ্রামীণ ফান্ড রফিককে তাঁর ব্যবসা, কারখানা আরো বড় করতে সহযোগিতার কথা বলে চুক্তিতে রাজি করায়। কিন্তু ইংরেজিতে লেখা চুক্তিপত্রের প্রথম অনুচ্ছেদেই বলা হয়েছে, 'এই মুহূর্তে তিন চাকার অটোভ্যান উৎপাদনের সুবিধা বগুড়ার শেরপুরে রয়েছে বিধায় সেখানেই উৎপাদনকাজ চলবে। তবে ভবিষ্যতে তা যেকোনো সুবিধামতো স্থানে করা যাবে।'
রফিক বলেন, 'চুক্তিতে যে এ রকম শর্ত আছে, আমি বুঝিনি।' পরে রফিককে না জানিয়েই ঢাকার সাভারে প্রতিষ্ঠা করা হয় আরেকটি কারখানা, আর খেজুরতলারটি এখন তালাবদ্ধ।
চুক্তিপত্রের ৬ নম্বর অনুচ্ছেদে কম্পানির বোর্ড সদস্যের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে। রফিক কারখানার মূল মালিক হলেও বোর্ডে তাঁকে পরিচালক (উৎপাদন) রেখে তাঁর মাত্র দুজন প্রতিনিধি রাখা হয়। প্রকৌশলী হাসানের রাখা হয় একজন। আর গ্রামীণ ফান্ড চারজন পরিচালক রাখতে পারবে। কম্পানির চেয়ারম্যান থাকবেন গ্রামীণ ফান্ডের মনোনীত একজন, আর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হবেন বোর্ডের মনোনীত কেউ। পরে গ্রামীণ ফান্ডের ইচ্ছায়ই এমডি করা হয় হাসান রেজাকে। যাঁর মেধা ও শ্রমের কল্যাণে দেশে প্রথম পরিবেশবান্ধব অটোভ্যান তৈরি হয়, সেই রফিককে রাখা হয় শুধুই একজন পরিচালক করে।
আবার আগের চুক্তিপত্রের শর্ত ভঙ্গ করে গ্রামীণ ফান্ড ২০০৪ সালের ৬ এপ্রিল আরেকটি চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করায় রফিককে। এটিতে বলা হয়, রফিক তাঁর নিজ খরচে অটোভ্যানের বডি তৈরি করবে, তবে তা নিজের কারখানায় নয়, অন্য কোনো জায়গায়। গ্রহণযোগ্য বডির মূল্য রফিক অটোভ্যান ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড পরিশোধ করবে। এই চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকেই রফিক আর পরিচালক (উৎপাদন) থাকবেন না।
মূলত এই চুক্তির পরই রফিককে কম্পানি থেকে কাগজে-কলমে বের করে দেওয়া হয়। এমনকি রফিককে গাড়ির বডি তৈরির কোনো কার্যাদেশও দেওয়া হয়নি।
ঋণের জালে রফিক: রফিকের কারখানার মালামাল নিয়ে কম্পানিতে তাঁর শেয়ার ধরা হয়; কিন্তু তাঁর মেধার কোনো মূল্য ধরা হয়নি। রফিক গ্রামীণ ফান্ড থেকে যে ঋণ নিয়েছিলেন, এরও কোনো সুরাহা না করেই চুক্তি সম্পাদন করা হয়।
কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে জানা গেছে, গ্রামীণ ফান্ডের সঙ্গে চুক্তির আগে মেসার্স রফিক অটোভ্যান ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রিজের নামে রফিকুল ইসলাম ছয় লাখ টাকা ঋণ নেন। পরে পাঁচ কিস্তিতে এক লাখ ২৫ হাজার টাকা পরিশোধও করেন। গ্রামীণ ফান্ডের সঙ্গে যৌথ ব্যবসা শুরু করার পর তিনি ঋণ পরিশোধ করেননি। ভেবেছিলেন, বড় কারখানা হয়েছে, সঙ্গে যাঁরা আছেন, তাঁরাই ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা করবেন; কিন্তু তা হয়নি। ঋণের বিপরীতে সুদ-আসলে সাত লাখ ৯ হাজার ৩৩৩ টাকা দাবি করে গ্রামীণ ফান্ড রফিকের কাছ থেকে একটি ব্যাংক চেক নেয়। ওই চেক ডিসঅনার করিয়ে রফিকের বিরুদ্ধে মামলা পর্যন্ত করে গ্রামীণ ফান্ড। মামলাটি এখন বিচারাধীন ঢাকার ষষ্ঠ যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ আদালতে। কাল রবিবার এ মামলার চূড়ান্ত শুনানি হওয়ার কথা। রফিকের আইনজীবী জানিয়েছেন, মামলায় রফিকের সাজাও হতে পারে।
রফিকের আইনজীবী ফয়সাল রেজা কালের কণ্ঠকে বলেন, যে প্রতিষ্ঠান রফিককে সহযোগিতা করতে তাঁর সঙ্গে অংশীদারি চুক্তিতে ব্যবসা শুরু করে, সেই প্রতিষ্ঠানই তাঁকে মামলায় জড়িয়ে দিয়েছে। তাঁকে সর্বস্বান্ত করে ছেড়েছে। তিনি প্রশ্ন তোলেন, 'যাঁকে প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্ব নিয়েছিল গ্রামীণ ব্যাংকের মতো এত বড় একটি প্রতিষ্ঠান, তাঁকে কেন পথে বসতে হচ্ছে?'
চুক্তির কিছুই পাননি রফিক : গ্রামীণ ফান্ডের সঙ্গে রফিকের চুক্তির পর এ পর্যন্ত তাঁকে কোনো লভ্যাংশ দেওয়া হয়নি। এমনকি রফিককে মাসিক ৩০ হাজার টাকা বেতন দেওয়ার কথা থাকলেও তা দেওয়া হয়নি। রফিককে বাদ দিয়েই গ্রামীণ ফান্ড এ অটোভ্যান তৈরি করে দেশব্যাপী বাজারজাত করছে।
রফিকুল ইসলাম বলেন, 'বিষয়গুলো নিয়ে ড. ইউনূসকে লিখিত ও মৌখিকভাবে জানাই। কিন্তু তিনি আমার কোনো কথা না শুনেই বলেন, এসব নিয়ে আমি কিছু করতে পারব না। গ্রামীণ ফান্ডের এমডির সঙ্গে যোগাযোগের কথা বলেন তিনি। ড. ইউনূসের কাছে অভিযোগ করায় গ্রামীণ ফান্ডের লোকজন ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকে একাধিকবার লাঞ্ছিত করেন। তারপর থেকে ধীরে ধীরে কৌশলে আমাকে বিভিন্ন অপবাদ দিয়ে বিতাড়িত করেন।'
একটি চিঠি : কম্পানির কর্মকর্তা মামুন আলী খানের (এঙ্িিকউটিভ অ্যাকাউন্টস) একটি চিঠি কালের কণ্ঠের হাতে আছে। ওই চিঠিটি ২০০৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর কম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালককে লেখা হয়েছিল। চিঠিতে উল্লেখ আছে, রফিকের গাড়ি মেরামতের ৯০ হাজার ৩৪৭ টাকার ভাউচার নাকচ করে তাঁর ওই টাকা দেওয়া হয়নি। শেরপুরের কারখানা ভাড়া বাবদ ৯৩ হাজার টাকাও কম্পানির কাছে রফিক পাবেন। ২০০৪ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত রফিকের বেতনও তাদের কাছে পাওনা রয়েছে। ২০০৩ সালের বেতনও রফিককে দেওয়া হয়নি বলে ওই চিঠিতে উল্লেখ রয়েছে। অবশ্য রফিককে বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক দেনাও দেখানো হয়েছে। কারখানা সাভারে স্থানান্তরের পর গ্রামীণ ফান্ড রফিকের কাছে টাকা পাবে বলে দাবি করে আসে।
গোপনে কারখানা সাভারে: গ্রামীণ ফান্ডের একজন কর্মচারীর দেওয়া তথ্য মতে গত ২৮ ডিসেম্বর সরেজমিনে ঢাকার সাভার উপজেলার হেমায়েতপুরের ঋষিপাড়া এলাকায় গিয়ে কথা হয় ষাটোর্ধ্ব আলাউদ্দিন মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, 'গ্রামবাংলা অটোভ্যান নামের গাড়ি ২০০৪ সাল থেকে এ এলাকায় উৎপাদন করা হতো। তবে ২০০৭ সালে কারখানাটি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।' আরো খোঁজ নিয়ে ওই দিনই দুপুরে সাভারের রাজাসন এলাকার ডেল্টার মোড়ে গিয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় যুবক মিজানুর রহমান বলেন, ভেতরেই অটোভ্যান তৈরির কারখানা আছে। মোড় থেকে পশ্চিম দিকে এগোতেই সরু একটি গলির মাথায় দেয়ালঘেরা কারখানা। ভেতরে টুংটাং শব্দ। বাইরে নেই কোনো সাইনবোর্ড কিংবা কম্পানির পরিচিতি। ভেতরে ঢুকতেই কারখানার স্টোর ইনচার্জ আনিসুর রহমান খসরু এগিয়ে এসে বলেন, 'এই জমি ও স্থাপনার মালিক আবু নাসের মো. শাহেদ। তাঁর কাছ থেকে প্রতি মাসে ৪০ হাজার টাকার বিনিময়ে কারখানা ভাড়া নিয়েছে রফিক অটোভ্যান ম্যানুফ্যাকচারিং কম্পানি।' 'যাঁর নামে কারখানা, সেই রফিক কি কখনো এখানে এসেছেন?' জবাবে খসরু বলেন, রফিক ছাড়া আর সবাই এসেছেন।
কারখানার ভেতরে উঁকি দিতেই চোখে পড়ে ১০ থেকে ১২ জন শ্রমিক-মিস্ত্রি অটোভ্যান তৈরিতে ব্যস্ত। সাতটি অটোভ্যান বানিয়ে পাশে রাখা হয়েছে। কারখানার ফোরম্যান নায়েব আলী বলেন, এখন মন্দা সময়। মাসে ১৫ থেকে ২০টি গাড়ি তৈরি হয়, তবে জানুয়ারির পর থেকে আরো বেশি হবে। তিনি বলেন, এসব অটোভ্যান মাগুরা, পাবনা, রাজবাড়ীসহ বিভিন্ন এলাকার ক্রেতারা এসে এখান থেকে কিনে নিয়ে যান। তবে টাকা লেনদেন হয় মিরপুরের গ্রামীণ ব্যাংক ভবনের প্রধান কার্যালয়ে।
বক্তব্যের জন্য গ্রামীণ ব্যাংক ভবনে : একই দিনই গ্রামীণ ব্যাংক ভবনের ১৩ তলায় অটোভ্যান কম্পানির কার্যালয়ে গিয়ে কথা হয় এমডি হাসান রেজার সঙ্গে। চুক্তির পর থেকে রফিকের সঙ্গে প্রতারণা এবং তাঁকে কৌশলে কম্পানি থেকে বের করে দেওয়ার প্রসঙ্গ তোলা হলে তিনি বলেন, 'রফিক একটা বাজে লোক। সে কম্পানির লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছে।'
'চুক্তি অনুযায়ী রফিককে বেতন না দেওয়া আর গাড়ির বডি তৈরির দায়িত্ব দেওয়ার কথা থাকলেও কোনো অর্ডার দেননি কেন' জানতে চাইলে হাসান রেজা বলেন, 'সে যে গাড়ির বডি তৈরি করে, সেটা কয়েক মাসেই ভেঙে যায়, টেকসই হয় না। কম্পানির বদনাম তো আমরা করতে দিতে পারি না।' 'আগে রফিক অনেক গাড়ি বানিয়ে বিক্রি করেছেন, সেগুলো তো ভালোই চলেছে' বলা হলে হাসান রেজা বলেন, 'এখন যেটা বানাচ্ছি, সেটা ভটভটি, নসিমন নয়_এটা পরিবেশবান্ধব অটোভ্যান।' 'আপনাদের সঙ্গে চুক্তির আগেই তো রফিক পরিবেশ অধিদপ্তর, বিআরটিএ, বুয়েটসহ বিভিন্ন দপ্তর থেকে অনুমোদন এনেছিলেন।' এমডি এবার ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, 'রফিক একজন ভ্যানচালক, সে-ই সব কিছু করেনি, আমি তাকে ওই সময় সহযোগিতা করেছিলাম। রফিক কম্পানির টাকা মেরে গ্রামের বাড়িতে দোতলা বিল্ডিং দিয়েছে, অনেক জমিজমাও কিনেছে।' 'আপনাদের সঙ্গে চুক্তির আগেই তো রফিক বাড়ি করেছেন।' এমডি বলেন, 'ঋণের টাকায় বাড়ি করেছিল, পরে আমাদের টাকা দিয়ে সেই ঋণ শোধ করেছে।'
ফান্ডের পরিচালক ও উপমহাব্যবস্থাপক কাজী সুলতান আহমেদ বলেন, 'কারখানায় লাভ না হলে তো রফিককে বেতন দিতে পারি না।'
গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি ড. ইউনূসের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তা সম্ভব হয় না। তবে মহাব্যবস্থাপক (ইন্টারন্যাশনাল প্রোগ্রাম ডিপার্টমেন্ট) জান্নাত-ই কাওনাইন কালের কণ্ঠকে বলেন, '৩০ বছর ধরে ইউনূস স্যারের সঙ্গে কাজ করছি। তিনি কোনো মানুষের খারাপ চাননি। এখন ওনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে।' তিনি বলেন, 'এই রফিক আর করিমরা আগে কোথায় ছিলেন? এখন কেন এসব কথা বলা হচ্ছে?'
রফিকের আকুল আবেদন : কম্পানিতে রফিকের মনোনীত পরিচালক মোশারফ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, কম্পানির এমডি হাসান রেজা ও গ্রামীণ ফান্ডের লোকজন কৌশলে রফিকের সঙ্গে প্রতারণা করে প্রতিষ্ঠানটি হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে।
রফিকের মনোনীত আরেক পরিচালক মুস্তাফিজুল করিম মানিকেরও একই কথা। তিনি বলেন, কম্পানির সব কাগজপত্র রফিকের নামে; কিন্তু একটি মাত্র কালো চুক্তি রফিকের সর্বনাশ করেছে।
রফিক বলেন, 'শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসের প্রতিষ্ঠান আমার কারখানায় অংশীদার হয়ে আমার শান্তি কেড়ে নিয়েছে। তিনি অনেক ওপরের মানুষ। তাঁর কাছে আমার আকুল আবেদন, আমাকে মুক্তি দিন। আমার শান্তি ফিরিয়ে দিন।'

No comments:

Post a Comment