Saturday, January 15, 2011

বেসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রে ইচ্ছামতো ফি আদায়

বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক এবং রোগ নির্ণয় কেন্দ্রগুলো রোগীদের কাছ থেকে ইচ্ছামতো ফি আদায় করছে। একেকটি সেবার ফি একেক স্থানে একেক রকম। ফলে ভোগান্তি হচ্ছে জনমানুষের। এ বিষয়ে তিন দশকের পুরনো একটি আইন আছে। তবে তা কেউ মানে না। আইনটি যুগোপযোগী করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এ পর্যন্ত সাতবার। তবে তা করতে দেয়নি ‘সুবিধাভোগী গোষ্ঠী’। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, বাংলাদেশের শতকরা ৬৮ ভাগ লোক বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোয় চিকিৎসা নেয়। এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে রোগীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ফি আদায়ের অভিযোগ রয়েছে।
বিষয়টি স্বীকার করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. আ ফ ম রুহুল হকও। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছে, এটা দুঃখজনক। স্বাস্থ্যমন্ত্রী আরো বলেন, ‘বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা পরিস্থিতি আমার নজরে আছে। এ বিষয়টি নিয়ে আমিও ভাবছি। যার যা খুশি করবে, ফি আদায়ের ক্ষেত্রে কোনো নিয়ম-শৃঙ্খলা থাকবে না, এটা হতে পারে না।’ মন্ত্রী জানান, সরকার পুরো স্বাস্থ্যসেবা খাতকে একটা সুশৃঙ্খল অবস্থায় নিয়ে যেতে চায় এবং তা নিয়ে কাজ হচ্ছে।
ফির রকমফের : রাজধানীর বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজে ইকোকার্ডিওগ্রাম (সাদাকালো) করতে ৭০০ টাকা নেয়। একই পরীক্ষা করাতে কমফোর্ট হাসপাতালে এক হাজার, স্কয়ার হাসপাতালে ১২২৭, ল্যাবএইডে ১০০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। আলট্রাসনোগ্রাম (ফুল অ্যাবডোমেন, রঙিন) করাতে কমফোর্ট হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে ১২০০ টাকা, ল্যাবএইডে ১২০০ ও স্কয়ারে ১৪৩২ টাকা। এই পরীক্ষাটি বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৮০০ টাকা, গ্রিন রোডের সন্ধানী ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ৬০০ টাকায়ও করানো যায়।
ইটিটি (এক্সারসাইজ টলারেন্স টেস্ট) করতে ল্যাবএইডে খরচ হয় ২০০০ টাকা ও স্কয়ার হাসপাতালে দুই হাজার ১৭৩ টাকা। ল্যাবএইড হাসপাতাল ব্রেনের সিটিস্ক্যান করতে চার হাজার টাকা নেওয়া হয়। এ পরীক্ষাটি করাতে পপুলার হাসপাতালে সাড়ে তিন হাজার ও স্কয়ার হাসপাতালে চার হাজার ৯০ টাকা নেওয়া হয়। ব্রেনের এমআরআই করাতে ল্যাবএইড সাড়ে ছয় হাজার, স্কয়ার সাত হাজার ১৫০, পপুলার ছয় হাজার টাকা নিচ্ছে।
সিমগা মেডিক্যাল, ন্যাশনাল ডায়াগনস্টিক কমপ্লেক্স, সন্ধি ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং ফেইথ ল্যাব লিমিটেডÑএ চারটি রোগ নির্ণয়কেন্দ্রের অবস্থান মোহাম্মদপুরে। একই মানের হলেও এসব প্রতিষ্ঠানের সেবার মূল্যে পার্থক্য রয়েছে। রক্তের বিলিরুবিন পরীক্ষা করাতে সিমগা মেডিক্যালে ১৫০ ও ন্যাশনাল ডায়াগনস্টিক কমপ্লেক্সে ১০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। একই পরীক্ষার জন্য ফেইথ ল্যাব লিমিটেড এবং সন্ধি ডায়াগনস্টিক সেন্টার নিচ্ছে ২০০ টাকা। রক্তের সিবিসি (কমপ্লিট ব্ল্যাড কাউন্ট) পরীক্ষাটি করাতে পপুলার হাসপাতালে ৪০০ টাকা নেওয়া হয়, স্কয়ার হাসপাতালে এজন্য লাগে ৪১০ টাকা। আবার একই পরীক্ষা মোহাম্মদপুরের ন্যাশনাল ডায়াগনস্টিক সেন্টারে করানো যাচ্ছে ২০০ টাকায়।
হাসপাতাল ও ক্লিনিকে রোগী ভর্তি ফি ও বেড ভাড়ায়ও পার্থক্য আছে। রোগী ভর্তির আগে অগ্রিম জমা (ডিপোজিট) রাখতে হয় ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতালে ১০ হাজার টাকা, পপুলার স্পেশালাইজড হাসপাতালে পাঁচ হাজার এবং এ্যাপোলো হাসপাতালে ৩০ হাজার টাকা। স্কয়ার হাসপাতালে কক্ষের মান অনুযায়ী সর্বনিু ১০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা ডিপোজিট দিতে হয়। ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতালে রেজিস্ট্রেশনসহ ভর্তি ফি এক হাজার টাকা। পপুলার হাসপাতালে দিতে হয় ৫০০ টাকা। ল্যাবএইড হাসপাতালের শয্যার সর্বনিু দৈনিক ভাড়া ১৮০০ টাকা। টুইন শেয়ার ক্যাবিনের প্রতি বেডের ভাড়া ৩০০০ হাজার, ডিলাক্স ক্যাবিন পাঁচ হাজার টাকা। স্কয়ার হাসপাতালে সর্বনিু বেড ভাড়া দুই হাজার টাকা, টুইন শেয়ার কক্ষে প্রতি শয্যার ভাড়া সাড়ে তিন হাজার, সিঙ্গেল স্ট্যান্ডার্ড ৫৫০০, সিঙ্গেল ডিলাক্স ক্যাবিনের ভাড়া সাত হাজার ৫০০ টাকা। এ্যাপালো হাসপাতালে স্ট্যান্ডার্ড বেডের দৈনিক ভাড়া ২৫০০ টাকা, সেমি-প্রাইভেট তিন হাজার ৭৫০, সিঙ্গেল প্রাইভেট ক্যাবিনের ভাড়া ছয় হাজার ৭৫০ টাকা। ডিলাক্স ক্যাবিনের দৈনিক ভাড়া আট হাজার টাকা। পপুলার হাসপাতালে সাধারণ ওয়ার্ডের বেড ভাড়া দেড় হাজার টাকা। সম্প্রতি এসব চিকিৎসাকেন্দ্রে খোঁজ নিয়ে এসব তথ্য পাওয়া যায়।
২৪ নভেম্বর বুধবার গ্রিন রোডের কমফোর্ট হাসপাতাল থেকে পাঁচ বছরের জাবের হোসেনকে নিয়ে বেরুচ্ছিলেন ওয়ারির বাসিন্দা আবদুস সাত্তার। হার্নিয়া অপারেশন হয়েছে শিশু জাবেরের। কমফোর্টের সেবা নিয়ে সন্তুষ্ট হলেও সেবার মূল্য নিয়ে অভিযোগ সাত্তারের। তিনি বলেন, ‘অপারেশন করাতে বিকেল ৩টায় হাসপাতালে এসেছি। ছোট্ট একটা অপারেশনের জন্য বিল করেছে সাড়ে ১৩ হাজার টাকা।’ তার মতে, মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য এ অঙ্কটা বেশি। হাসপাতালগুলোর বিভিন্ন ফি’র বিষয়ে সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত।
বেসরকারি হাসপাতালের খরচের বিষয়ে ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতালের গণমাধ্যম সমন্বয়ক (মিডিয়া কো-অর্ডিনেটর) মেসবাহ য়াযাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এটা সত্য আধুনিক হাসপাতালগুলোর খরচ সাধারণ মানুষের কাছে বেশি মনে হয়। নতুন প্রযুক্তি, অত্যাধুনিক মেশিনারিজ ও স্থাপনা ব্যয় মিলে বিনিয়োগ বেশি করতে হচ্ছে। বর্তমান চার্জ আরো কমালে উন্নত সেবা দেওয়া সম্ভব হবে না। নানা কারণে একই মানের হাসপাতালগুলোর সার্ভিস চার্জের তারতম্য হয়। তবে এ বিষয়ে একটা নীতিমালা অবশ্যই তৈরি এবং প্রয়োগ করা উচিত।’
‘পুরনো আইন’ মানে না কেউ : বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সেবার ফি নির্ধারণ করা আছে ‘মেডিক্যাল প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস অ্যান্ড ল্যাবরেটরিজ (রেগুলেশন) অর্ডিন্যান্স, ১৯৮২’- এ। ২৯ হাসপাতাল মালিক ও চিকিৎসকরা বলছেন, আইনটি ‘অবাস্তব’, ‘অচল’Ñতাই মানা যায় না। বিএমএর মহাসচিব ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বর্তমান আইনে অপারেশন এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার নির্ধারিত ফি অবাস্তব। তবে হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো ক্ষেত্রবিশেষে অতিরিক্ত টাকা আদায় করছে।’ তিনি বলেন, ‘আইনটি যুগোপযোগী করতে অনেক চেষ্টা করেছি। তবে বিভিন্ন পক্ষের বাধার কারণে সেটা বাস্তবায়ন হয়নি।’ তবে কার বাধা ছিল তা বলেননি তিনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. মো. মুমতাজ উদ্দিন ভুইয়া বলেন, ‘প্রচলিত আইনটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ। এতে স্বাস্থ্যসেবার যে ফি আছে তা বর্তমানে মানার মতো না। কেউ মানেও না। হাসপাতালগুলো যেভাবে পারছে সার্ভিস চার্জ আদায় করছে।’ এরপরও হাসপাতালগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বেসরকারি হাসপাতালের সংখ্যা অনেক। কিন্তু আমাদের লোকবল খুবই সীমিত। তাই অভিযান চালানো যাচ্ছে না। তবে বর্তমান আইনটি সংশোধনে একটি খসড়া তৈরি করা হয়েছে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, সারা দেশে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ, হাসপাতাল ও ক্লিনিক রয়েছে দুই হাজার ৬০৮টি। অন্যদিকে সরকারি হাসপাতালের সংখ্যা ৬০৫টি। শুধু ঢাকা মহানগরীতে রয়েছে ৫৯২টি বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী সারা দেশে অনুমোদিত বেসরকারি রোগ নির্ণয়কেন্দ্রের সংখ্যা পাঁচ হাজার ১২২টি।
কী আছে বর্তমান আইনে : ‘মেডিক্যাল প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস অ্যান্ড ল্যাবরেটরিজ (রেগুলেশন) অর্ডিন্যান্স, ১৯৮২’-এর ৩ ধারায় বেসরকারি হাসপাতালগুলোর সার্ভিস চার্জ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। গল ব্লাডার, পিত্তথলির পাথর ও সিজারিয়ান অপারেশনের জন্য সব মিলিয়ে সর্বোচ্চ ব্যয় ধরা হয়েছে তিন হাজার ৪০০ টাকা। অ্যাপেনডিক্স ও মূত্রথলি অপারেশনের ব্যয় ১৬০০ টাকা। নরমাল ডেলিভারি জন্য লেবার রুম চার্জসহ ৪০০ টাকা। হার্নিয়া অপারেশনের জন্য সর্বোচ্চ ব্যয় ধরা হয়েছে ৮৫০ টাকা। এ ছাড়া রক্তের সিবিসি (কমপ্লিট ব্ল্যাড কাউন্ট) পরীক্ষার জন্য ফি ধরা হয়েছে ৩৪ টাকা।
তবে ২৯ বছর আগে নির্ধারিত এ ফি নিয়ে এখন অপারেশন কিছুতেই সম্ভব নয় বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। কমফোর্ট নার্সিং হোম (প্রা.) লিমিটেডের ব্যবস্থাপক সরকার আহসানুল হক সেলিম বলেন, ‘বর্তমানে ঢাকার যেকোনো হাসপাতালে গল ব্লাডারের অপারেশন করাতে কমপক্ষে ৩০ হাজার ও অ্যাপেনডিক্স অপারেশনে ২০-২৫ হাজার টাকা প্রয়োজন।’
খসড়া হয়, আইন হয় না : স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮২ সালের আইন যুগোপযোগী করতে এ পর্যন্ত সাতবার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তৈরি হয়েছে খসড়া আইন। কিন্তু চিকিৎসাসেবায় জড়িত বিভিন্ন সংগঠন ও সরকারের সদিচ্ছার অভাবে তা করা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘সরকারের উদাসীনতা এবং এ সেক্টরের লোকজনের কারণে এত দিনেও এ বিষয়ে আইন হয়নি। ব্যবসায়িক কারণে বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিকের মালিকরা আইন বাস্তবায়নের বিপক্ষে বিভিন্ন সময় তৎপর ছিল।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৭, ১৯৯৯, ২০০১, ২০০৩, ২০০৪, ২০০৬ এবং ২০০৭ সালে পুরনো আইনের স্থলে যুগোপযোগী একটি আইন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ ২০০১ সালে ‘বেসরকারি স্থাস্থ্যসেবা আইন-২০০১’ নামে একটি আইনের খসড়া তৈরি করা হয়। তখনো বাস্তবায়ন হয়নি। এরপর এই খসড়ার কিছু পরিবর্তন করে ২০০৩, ২০০৪, ২০০৬ সালে আবার উদ্যোগ নিলেও আইনটি হতে পারেনি।
জাতীয় স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের আহ্বায়ক অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, পৃথিবীর প্রায় দেশেই স্বাস্থ্যসেবার একটা মানদণ্ড নির্ধারণ করা থাকে। ফলে মান নিশ্চিত না হলেই মানুষ আইনের আশ্রয় নিতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে সময়োপযোগী আইন না থাকায় এ বিষয়ে কারোর জবাবদিহিতাও থাকছে না। তিনি আরো বলেন, ‘সব সরকারের সময়ই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও আইন মন্ত্রণালয় খসড়া তৈরি করে। কিন্তু এরপর তা মন্ত্রিসভা পর্যন্ত যেতে পারে না।’

No comments:

Post a Comment