Saturday, January 15, 2011

শিরক ইমানকে ধ্বংস করে দেয়

'শিরক' তাওহিদের সম্পূর্ণ বিপরীত। তাই তাওহিদ বিষয়ের আলোচনায় প্রাসঙ্গিক হিসেবেই 'শিরক' চলে আসে। তাওহিদবিষয়ক জ্ঞান ব্যক্তিজীবনে মহান আল্লাহর সবচেয়ে বড় নিয়ামত। আর শিরক হলো নিজের সত্তার ওপর সীমাহীন জুলুম ও মহান আল্লাহর সঙ্গে বিদ্রোহের শামিল।

মহান আল্লাহর সত্তা, গুণাবলি, ক্ষমতা ও কার্যাবলিতে অন্য কাউকে শরিক করা বা সমকক্ষ মনে করাই শিরক। কারো অনুগ্রহের কথা ভুলে গেলে যদি নিমকহারাম বলা যায়, মা-বাবার আদেশ অমান্য করলে যদি অবাধ্য সন্তান বলা যায়, তাহলে যিনি জীবন দান করলেন, অতঃপর জীবনধারণের যাবতীয় উপাদান প্রয়োজানুপাতে পরিমিতহারে সরবরাহ করছেন, জীবনের চূড়ান্ত পরিণতি যাঁর ইচ্ছার ওপর নির্ভর করছে, সেই মহান সত্তার অবাধ্যতা কত বড় অপরাধ, বিবেকবান মানুষের জন্য তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। সুরা 'আর রাহমান'-এর মধ্যে মহান আল্লাহ বারবার স্বীয় অনুগ্রহের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, 'ফা বিআয়্যি আলা-য়ি রাবি্বকুমা তুকাজ্জিবান'_অতএব, তোমরা উভয়ে (মানুষ ও জিন) তোমাদের পালনকর্তার কোন কোন অবদানকে অস্বীকার করবে? পবিত্র কোরআনের অন্যত্র এরশাদ হয়েছে_'আচ্ছা বলো দেখি, কে এই শূন্য জগত সৃষ্টির দ্বারা পূর্ণ করেছেন আর বারবার তার পরিবর্তন ঘটাচ্ছেন? আর কে আকাশ ও পৃথিবী থেকে তোমাদের খাবার জোগাচ্ছেন। আল্লাহ ছাড়া আরো কোনো প্রভু তোমাদের আছে কি? হে রাসুল! আপনি বলে দিন, যদি তোমরা সত্যবাদী হও, (জগৎজোড়া সৃষ্টির প্রমাণের বিরুদ্ধে) তোমাদের যদি কোনো প্রমাণ থাকে, তাহলে তা পেশ করো।' (সুরা নামল, ৬৪ আয়াত) বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী অসকার লিও ব্রাউয়ার লিখেছেন_'সৃষ্টিকর্তা হিসেবে আল্লাহকে স্বীকৃতি দান এবং এর ফলে মহাবিশ্বের সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক হিসেবে আল্লাহকে মেনে নেওয়ার মাত্র একটা অর্থ থাকতে পারে, আর তা হলো_মানুষের প্রতি অমানুষি আচরণের পরিসমাপ্তি। এর অর্থ হবে, মানুষের মধ্যে নতুন প্রেরণা, একটি সংবেদনশীল বিবেক এবং একটি শুদ্ধ সিদ্ধান্তের অস্তিত্ব। এর অর্থ হবে প্রেম আর পবিত্রতা। নাস্তিকতার অর্থ হচ্ছে_দ্বন্দ্ব আর যুদ্ধ। বৈজ্ঞানিক হিসেবে আমি এর কোনোটিই চাই না। থিওরি হিসেবে আমি নাস্তিকতাকে অযৌক্তিক ও ভ্রান্ত মনে করি। বাস্তব দিক থেকে আমার মতে তা মারাত্মক ক্ষতিকর।' বস্তুত শিরক মানুষকে স্বার্থপর, হিংস্র, সংকীর্ণ দৃষ্টি, ভীত ও হীন মানসিকতাসম্পন্ন করে তার জীবনীশক্তি ধ্বংস করে দেয়। কারণ মুশরিক ব্যক্তির আকিদা-বিশ্বাস সৃষ্টির অতি ক্ষুদ্রতম অংশের মধ্যে নিবদ্ধ থাকে।
শিরক প্রধানত দুই প্রকার। শিরকে আকবার ও শিরকে আসগার। আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক বানানো, আল্লাহর জন্য স্ত্রী, পুত্র ও কন্যা সাব্যস্ত করা শিরকে আকবার। যেমন পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে, 'তারা জিনকে আল্লাহর শরিক স্থির করে। অথচ তিনিই তাদের সৃষ্টি করেছেন। আর তারা না জেনে আল্লাহর জন্য পুত্র-কন্যা সাব্যস্ত করে। তিনি অত্যন্ত পবিত্র, তারা যা বলে তা থেকে অনেক ঊধর্ে্ব।' (সুরা আনআম, ১০০ আয়াত) আল্লাহর কাছে মুনাজাত করার মতো জীবিত বা মৃত কারো কাছে বা কারো কবর বা মাজারে প্রার্থনা করা শিরকে আকবার। যেমন_ইয়া গাউসুল আযম বা ইয়া খানজাহান বা ইয়া খাজা গরীবে নেওয়াজ আমাকে একটি সন্তান দান করো, বিপদমুক্ত করো, ব্যবসায় উন্নতি দাও অথবা এ জাতীয় প্রার্থনাই শিরকে আকবারের শামিল। কোনো পীর, ফকির, দরবেশ, কবর বা মাজারের নামে মানত করা, কোনো পীরকে বা মাজারকে সিজদা করা, মাজার ছুঁয়ে শরীরে মর্দন করা, মাজারে বসে তপ-জপ করা, কোনো পীরের নামের তাসবিহ পাঠ করা শিরকে আকবার। খুব ভালোভাবে স্মরণ রাখা দরকার, ইবাদত বন্দেগির একমাত্র হকদার আল্লাহ। কোনো পীর, ফকির, দরবেশ বা বুজুর্গের বিন্দুমাত্র ক্ষমতা নেই যে অন্যের জন্য মঙ্গল বা অমঙ্গল কিছু করতে পারে। পবিত্র কোরআনে বহু আয়াতে এ বিষয়টি স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে_'আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্তার কাছে প্রার্থনা কোরো না, যে তোমার কোনো উপকার করতে পারে না এবং কোনো ক্ষতিও করতে পারে না। যদি তুমি এমনটি করো, তাহলে তুমি নিশ্চয়ই জালিমদের (মুশরিকদের) অন্তর্ভুক্ত হবে। আর আল্লাহ যদি তোমাকে কোনো বিপদে আক্রান্ত করেন, তাহলে তিনি ছাড়া অন্য কেউ তোমাকে তা থেকে উদ্ধার করতে পারবে না।' (সুরা ইউনুস ১০৬, ১০৭ আয়াত) কোনো পীর বা দরবেশের এ ক্ষমতাও নেই যে মৃত্যুর পর আল্লাহর আজাব থেকে কাউকে মুক্ত করবে বা কবরের আজাব সামান্য কমিয়ে দেবে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, যখন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওপর 'অ-আন্যির আশিরাতাকাল আকরাবীন' অর্থাৎ আপনার নিকটাত্মীয়দের সতর্ক করুন_আয়াতটি নাজিল হলো, তখন তিনি আমাদের কিছু বলার জন্য দাঁড়ালেন, এরপর তিনি বললেন, 'হে কোরাইশ বংশের লোকেরা, তোমরা তোমাদের জীবনকে খরিদ করে নাও (শিরক পরিত্যাগ করো) আল্লাহর কাছে জবাবদিহির ব্যাপারে আমি তোমাদের কোনো উপকার করতে পারব না।
হে আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব, আল্লাহর কাছে জবাবদিহির ব্যাপারে আমি তোমাদের কোনো উপকার করতে পারব না। হে রাসুলের ফুফু সাফিয়্যাহ, আল্লাহর দরবারে জবাবদিহির ব্যাপারে আমি আপনার কোনো উপকার করতে পারব না। হে মোহাম্মদের কন্যা ফাতিমা, আমার সম্পদ থেকে তুমি যা খুশি চাও, কিন্তু আল্লাহর সমীপে জবাবদিহির ব্যাপারে আমি তোমাকে কোনো উপকার করতে পারব না।' কোনো ব্যক্তি, সংস্থা বা সংগঠনকে জীবনবিধান প্রণয়নকারী হিসেবে মান্য করা ও বিশ্বাস করা শিরকে আকবার। আরবের বিখ্যাত দানবীর 'হাতেম তাই'-এর পুত্র আদি ইবনে হাতেম থেকে ইমাম আহমাদ, ইমাম তিরমিজি ও ইমাম ইবনে জারির বর্ণনা করেছেন, আদি ইবনে হাতেম প্রথম রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর খিদমতে উপস্থিত হলে তার গলায় রৌপ্যনির্মিত একটি ক্রুশ ঝুলতে দেখে রাসুলুল্লাহ (সা.) পবিত্র কোরআনের আয়াত পাঠ করলেন_'তারা আল্লাহকে ছেড়ে তাদের পণ্ডিত ও সংসারবিরাগীদের (পুরোহিতদের) রব হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং মাসীহ ইবনে মারইয়াকেও। অথচ তারা আদিষ্ট হয়েছিল এক ইলাহ (আল্লাহ)-এর ইবাদত করতে। তিনি ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই। তারা যা কিছু শরিক করে তিনি তা থেকে কতই না পবিত্র।' (সুরা তওবা ৩১ আয়াত) আদি ইবনে হাতেম বলেন, আমি তখন বললাম, তারা পাদ্রি-পুরোহিতদের মাবুদ বানায়নি। তখন রাসুল (সা.) বললেন, তারা নিশ্চয়ই পাদ্রি-পুরোহিতদের মাবুদ বানিয়েছে। পাদ্রি-পুরোহিতরা তাদের জন্য মহান আল্লাহর হালাল করা বিষয়কে হারাম বানিয়েছে এবং আল্লাহর হারাম করা বিষয়কে হালাল বানিয়েছে। আর তারা সেসব বিষয়ে পাদ্রি-পুরোহিতদের বিধি-ব্যবস্থাকে মেনে নিয়েছে। এটাই হলো পাদ্রি-পুরোহিতদের তাদের মাবুদ বানিয়ে নেওয়া। বান্দার যেসব চিন্তা-ভাবনা, কামনা-বাসনা, কাজ-কর্ম শিরকে আকবারের দিকে উৎসাহিত ও ধাবিত করে সেগুলো শিরকে আসগার।
শিরক ইমানকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। মুশরিক ব্যক্তি তার কোনো আমলেরই বিনিময় আল্লাহর কাছে পাবে না। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে_'যদি তুমি আল্লাহর সঙ্গে শরিক করো তাহলে তোমার সব আমলই বরবাদ হয়ে যাবে আর তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।' (সুরা জুমার, ৬৫ আয়াত) পবিত্র কোরআনের অন্যত্র এরশাদ হয়েছে_'যে আল্লাহর সঙ্গে শরিক করে নিশ্চয়ই আল্লাহ তার জন্য জান্নাতকে হারাম করে দিয়েছেন।' (সুরা মায়েদা, ৭২ আয়াত) মানুষের জীবনে গুনাহ বা পাপ সংঘটিত হওয়া খুবই স্বাভাবিক বিষয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন, রহমান ও রহিম। তিনি বান্দার গুনাহ মাফ করবেন। কিন্তু শিরক এমন জঘন্য পাপ যা মহান আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। মহান আল্লাহর ঘোষণা, 'নিশ্চয়ই আল্লাহ কখনো তাঁর সঙ্গে শরিক করার গুনাহ ক্ষমা করবেন না। এ ছাড়া অন্য সব গুনাহ যাকে ইচ্ছা তাকে তিনি ক্ষমা করবেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে কাউকে অংশীদার বানাল সে একটি মহাপাপে নিজেকে জড়াল।' (সুরা নিসা, ৪৮ আয়াত) রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, 'যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করা অবস্থায় মারা যাবে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।' প্রত্যেক মুমিন ব্যক্তির উচিত ইমানকে খাঁটি করার জন্য আকিদা-বিশ্বাস, কথা-কাজ ও ইবাদত-বন্দেগি সব ক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে নিখুঁতভাবে অনুসরণ করা। যাতে অজ্ঞতাবশত শিরকের স্পর্শে জিন্দেগির সব আমল বরবাদ হয়ে না যায়।

No comments:

Post a Comment