Saturday, January 15, 2011

পতিত জমিতে সবজি চাষে সুনিল-অলির চমক

সুনিল চন্দ্র সিকদার ও মো. অলি কারিগর। সুনিল পয়ষট্টিতে পেঁৗছেছেন। আর অলি ত্রিশ বছরের যুবক। বয়সের বাধা পেরিয়ে তাঁরা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। গড়েছেন নতুন অধ্যায়। কঠোর পরিশ্রম দিয়ে পতিত জমিতে নজরকাড়া সবজি চাষ করে পটুয়াখালীতে হৈচৈ ফেলে দিয়েছেন।

উভয়েই কৃষক পরিবারের সন্তান। কিন্তু অভাবের তাড়নায় তাঁদের সে পরিচয় ফিকে হয়ে যাচ্ছিল। অভাবগ্রস্ত সুনিল ও অলি পৈতৃক কৃষি পেশার পুরনো ঐতিহ্যকে জেগে তুলেছেন সবজি চাষে। নানা জাতের সবজি চাষ করে এখন আদর্শ কৃষক হিসেবে নিজেদের পরিচয় নতুনভাবে গড়েছেন। সেই সবজি বিক্রি করে দুই হাতে আয় করছেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। পতিত জমিতে তাঁদের দৃষ্টিনন্দন সবজি উৎপাদনের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ায় অনেকেই এসে ঘুরে দেখছেন বাগান।
বরিশাল বিভাগীয় কৃষি সম্প্রসারণের অতিরিক্ত পরিচালক মো. শাহ আলম এবং পটুয়াখালী জেলা খামারবাড়ির উপপরিচালক নিখিল রঞ্জন মণ্ডল বলেন, পতিত জমির সবজি বাগান দেখে উচ্ছ্বসিত না হয়ে থাকা যায় না।
পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার কনকদিয়া ইউনিয়নের দ্বিপাশা গ্রামের আদি বাসিন্দা সুনিল এবং অলি। তাঁদের বাড়ি দ্বিপাশা-বীরপাশা রাস্তার মাঝামাঝি স্থানে। আর ওই রাস্তার দুই পাশজুড়ে পতিত জমিতে গড়ে তুলেছেন টমেটো, করলা, বেগুন, শালগম, শসা, লাউ, চিচিঙ্গা, ফুলকপি, বাঁধাকপি এবং মরিচসহ নানা জাতের সবজির বাগান। যেকোনো আগন্তুক ওই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় ফলন্ত সবজিবাগান দেখে থমকে দাঁড়ান। কারণ ওই রাস্তার পাশের পতিত জমিগুলো বরাবরই ছিল অযত্নে-অনাবাদি। সেই জমিতে এখন শোভা পাচ্ছে নানা জাতের সবজির গাছ। আর গাছে ঝুলে আছে হরেক রকম সবজি। এমন দৃশ্য পথিককে থামিয়ে চোখ বোলাতে বাধ্য করে। শুধু রাস্তার পাশের পতিত জমিই নয়, চাষের আওতায় নেওয়া হয়েছে ধান ক্ষেতের আইল এবং আশপাশের সব পরিত্যক্ত ভিটে এবং পুকুরপাড়। দুজনে প্রায় সাড়ে ৪ একর পতিত জমিতে সবজি ফলিয়েছেন।
জানা যায়, স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর প্রান্তিক কৃষকসহ বেকার যুবকদের সবজি চাষে উদ্বুদ্ধকরণ প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৪০০ কৃষককে প্রশিক্ষণসহ পরামর্শ প্রদান করেন। এদের মধ্যে ১১০টি সবজি খামার গড়েছেন কৃষকরা। তবে তাঁরা সবাই চাষের জন্য বেছে নিয়েছেন আবাদি জমি। কিন্তু পতিত জমিতে ব্যতিক্রম এ উদ্যোগ নিয়ে সফল হয়েছেন সুনিল ও অলি। প্রতিদিন তাঁদের বাগানের সবজি যায় স্থানীয় বগা, বাহেরচর, কালিশুরী, কাছিপাড়া, নুরাইনপুর, কনকদিয়া, বীরপাশা, বাউফল, পাড়েরহাট, আয়লা ও বিলবিলাস বাজারে। এরই মধ্যে এসব বাগান থেকে সবজি বিক্রি করেছেন প্রায় এক লাখ টাকার। বড় ধরনের কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় না হলে চলমান প্রকল্প থেকে আরো তিন লাখ টাকার অধিক সবজি বিক্রির সম্ভাবনার কথা জানান তাঁরা। অথচ ছয় মাস আগেও অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করে সংসার চালিয়েছেন সুনিল ও অলি। এখন তাঁরা বেশ খুশি। তবে অনুযোগও রয়েছে। সবজি চাষে অর্থের জোগান পেয়েছেন উচ্চ সুদে বিভিন্ন এনজিওর কাছ থেকে। এ কারণে লাভের একটা বড় অংশ দিয়ে পরিশোধ করতে হয় ঋণের টাকা। তাই এ উদ্যোগের ব্যাপক প্রতিফলনের জন্য সাধারণ কৃষককে সরকারি ব্যাংক থেকে জমির নিরাপত্তা ছাড়া স্বল্প সুদে ঋণের দাবি তাঁদের।
সুনিল চন্দ্র সিকদার বলেন, 'চিন্তাও করি নাই এত ভালো ফলন অইবে। বাবা, এহন বাগানের দিগে চাইলে পরানডা জুড়াইয়া যায়। সরকার যদি আমাগো মোত গরিবেরে কোম সুদে লোনের ব্যবস্থা কইর‌্যা দেতে, তাহেলে অনেক মানুষ সবজি ফলাইতে, অভাব কোমতে গ্রামের মাইনস্যের।'
মো. অলি কারিগর বলেন, 'আমাগো সবজি দেইক্যা সবাই আমাগো সুনাম কয়, ভালো টাহাও পাই বেইচ্যা, সংসারে অভাবও নাই, কিন্তু লোনের লইগ্যা সুদে লইয়া যায় ব্যামালা টাহা'।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, পটুয়াখালীর উপপরিচালক নিখিল রঞ্জন মণ্ডল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সাধারণ মানুষ এবং প্রান্তিক চাষিদের উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে অনাবাদি থাকা পতিত জমি চাষের আওতায় নেওয়া গেলে অনেকেই সুনিল এবং অলির মতো উদাহরণ সৃষ্টিকারী হতে পারত। গ্রামাঞ্চলে অভাবী মানুষের সংখ্যা কমে যেত। এ ছাড়া সবজির দামও সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে চলে আসত। সুনিল-অলি কৃষি সেক্টরে অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত'।

No comments:

Post a Comment