Saturday, January 22, 2011

শেয়ারবাজারে- বিশেষ গোষ্ঠীর কারসাজি!

দেশের শেয়ারবাজার চরম এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। অব্যাহত দরপতনের ফলে লাখ লাখ সাধারণ বিনিয়োগকারী এখন সর্বস্বান্ত হওয়ার পথে। এরই মধ্যে গত বৃহস্পতিবার ধরা পড়েছে অভিনব কারসাজির ঘটনা। বেরিয়ে আসছে আরো অনেক তথ্য। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত সেপ্টেম্বর মাসে ‘একটি গোষ্ঠী’ শেয়ারবাজারে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে শুরু করে।

নামে-বেনামে বিপুলসংখ্যক বিও অ্যাকাউন্ট খুলে তারা বিপুল পরিমাণ শেয়ার কিনে মূল্যবৃদ্ধি ঘটায় এবং একপর্যায়ে মুনাফা নিয়ে সটকে পড়ে। এ ছাড়া কর্তৃপক্ষের কিছু সিদ্ধান্তও শেয়ারবাজারকে অস্থিতিশীল করে বলে বিভিন্ন সূত্র জানায়। গতকাল শুক্রবার অর্থমন্ত্রীও স্বীকার করেছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ তাঁরও এ ক্ষেত্রে কিছু ভুল ছিল।
১৯৯৬ ও ২০১১ সালÑদুই বারই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। তাই ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের কেউ কেউ এ দুই কেলেঙ্কারির দায় আওয়ামী লীগের কাঁধে চাপাচ্ছে। বিষয়টিকে পুঁজি করতে চাইছে প্রধান বিরোধী দলও। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই শেয়ারবাজারে কেলেঙ্কারি হয়। নিজেদের দলের লোকদের টাকা বানানোর সুযোগ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে অতিমুনাফার ফাঁদ পেতে সাধারণ মানুষকে শেয়ারবাজারে ডেকে আনে। আর সুযোগ মতো টাকা উঠিয়ে বাজার থেকে সরে পড়ে। পথে বসে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
আবার অনেক বিনিয়োগকারী বলছে, বিএনপিপন্থী একটি গোষ্ঠী অব্যাহতভাবে এ কারসাজি করে যাচ্ছে, যাতে ১৯৯৬ সালের মতো আরেকটি কেলেঙ্কারির ঘটনা আওয়ামী লীগ সরকারের ঘাড়ে চাপানো যায়। বিশ্লেষক থেকে শুরু করে বহু বিনিয়োগকারী বলছে, এসব কেলেঙ্কারির ঘটনায় কারা জড়িত একটু সক্রিয় হলেই নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা খুঁজে বের করতে পারে। শেয়ারের লেনদেনের হিসাব পর্যালোচনা করলেই অস্বাভাবিক লেনদেনকারী ব্যক্তি, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও ব্রোকারেজ হাউস শনাক্ত করা সম্ভব। কেউ কেউ এমনও বলছেন, ২০-২৫ জনের সংঘবদ্ধ একটি দল শেয়ারবাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা উঠিয়ে দেশের বাইরে পাচার করেছে। খোদ ডিএসই সভাপতি গত বৃহস্পতিবার এ ঘটনার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি করেছেন। অনেক দেরিতে হলেও এসইসি সন্দেহভাজন ব্রোকারেজ হাউসগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে।
‘একটি গোষ্ঠীর কাজ’ : এ বছরের সেপ্টেম্বর মাসের শুরুর দিকে একটি গোষ্ঠী শেয়ারবাজারে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে শুরু করে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র দাবি করেছে। ডিএসইর সাধারণ মূল্যসূচক সাড়ে ছয় হাজারের কাছাকাছি থাকা অবস্থায় চক্রটি কয়েকটি মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসের মাধ্যমে ওই টাকা বিনিয়োগ শুরু করে। এর আগে এসব প্রতিষ্ঠানে নামে-বেনামে বিপুলসংখ্যক বিও অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত এসব অ্যাকাউন্ট খোলা ও বিনিয়োগ করা হয়। এসব বিও অ্যাকাউন্টে প্রতিদিন ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার শেয়ার কেনা হয়। এর মাধ্যমে প্রতিদিনই তালিকাভুক্ত বেশির ভাগ কম্পানির শেয়ারের দর বাড়ানো হয়। এর প্রভাবে তিন মাসের ব্যবধানে ডিএসইর সাধারণ সূচক প্রায় আড়াই হাজার পয়েন্ট বেড়ে প্রায় ৯ হাজারের ঘরে পৌঁছে।
পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো এ চক্রটি সম্পর্কে দিয়েছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। তাদের দাবি, বৃহস্পতিবার শাস্তি পাওয়া ছয়টি প্রতিষ্ঠানের কেউ কেউসহ আরো অনেক ব্রোকারেজ হাউসের মালিক বিএনপিপন্থী হিসেবে পরিচিত। তবে তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হয় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক একজন সভাপতিসহ আওয়ামী লীগপন্থী হিসেবে পরিচিত ব্রোকারেজ হাউসের কয়েকজন মালিক। তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন অতি মুনাফার লোভে শেয়ারবাজারকে অস্বাভাবিক ফুলিয়ে-ফাপিয়ে তুলতে ভূমিকা রাখেন। তাঁদের মধ্যে একজন সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ঘনিষ্ঠতা কাজে লাগিয়ে ডিএসইর নেতৃত্বে নিজের প্রভাব বজায় রেখেছেন। আওয়ামীপন্থী হিসেবে পরিচিত ডিএসইর সামনের সারির অধিকাংশ নেতার বিরুদ্ধে ১৯৯৬ সালের কেলেঙ্কারির মামলা রয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর একাধিক কম্পানির শেয়ারের দর বৃদ্ধির পেছনেও তাঁদের কারসাজি রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তাঁরা পুঁজিবাজারে প্রবেশমুখে সরাসরি তালিকাভুক্ত ও বুকবিল্ডিং পদ্ধতিতে তালিকাভুক্ত কয়েকটি কম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
গত ডিসেম্বরের কিছু ঘটনাকেও আজকের পরিস্থিতির জন্য দায়ী করছেন অনেক বিনিয়োগকারী। গত ৬ ও ৭ ডিসেম্বর এসইসির চেয়ারম্যান জিয়াউল হক খোন্দকারের অনুমোদন ছাড়াই কমিশন সদস্য মনসুর আলম চেক ও নেটিং সুবিধা-সংক্রান্ত দুটি নির্দেশনা জারির ব্যবস্থা করেন। চেয়ারম্যানের বিদেশ সফরের কারণে ওই সময় মনসুর আলম ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করছিলেন। এসইসির এ নির্দেশনাটি ৭ ডিসেম্বর নজিরবিহীনভাবে ডিএসইর ওয়েবসাইটে মোট আটবার প্রদর্শন করা হয়। ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বড় রকমের বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে চেকের মাধ্যমে অর্থ জমা দেওয়া যাবে নাÑএ ধরনের গুজবে বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। পরদিন লেনদেন শুরুর পর বাজারে বড় ধরনের ধস নামে। সোয়া এক ঘণ্টার মধ্যে ডিএসই সাধারণ সূচক আগের দিনের চেয়ে ৫৪৬ পয়েন্ট কমে যায়। এ ঘটনায় এসইসি চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। ঘটনার জের ধরে গত ১২ জানুয়ারি মনসুর আলম পদত্যাগ করেন।
অনেক বিনিয়োগকারী মনসুর আলমকে বলে থাকে বিএনপিপন্থী। প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচয় প্রদানকারী ডিএসইর সাবেক ওই সভাপতির সঙ্গে মনসুর আলমের বিশেষ ঘনিষ্ঠতার কথা তখন ডিএসই ও এসইসিতে আলোচনার খোরাক ছিল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এসইসির এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, মনসুর আলমকে দিয়ে ওই নির্দেশনা জারি করাতে ডিএসইর ওই সাবেক সভাপতি বিশেষ ভূমিকা রাখেন। এই নির্দেশনা জারির আগেই তিনি নিজের পোর্টফোলিও থেকে সব শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন বলেও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। ৮ ডিসেম্বরের পর থেকে যে দরপতন ও অস্থিরতা তৈরি হয়, এরই পরিণতিতে ২০ জানুয়ারির সর্বশেষ দরপতন ও লেনদেন বন্ধের ঘটনা ঘটে।
গত বৃহস্পতিবারের দরপতনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ছয়টি ব্রোকারেজ হাউসের লেনদেন কার্যক্রম এক মাসের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের এক মাসের জন্য দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। চার দিন বন্ধ হয়ে গেছে শেয়ারবাজারের লেনদেন। রবিবারও বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে লেনদেন। হয়তো এ বন্ধের মেয়াদ আরো বাড়ানো হবে।
ব্যাংকের দায় : বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুঁজিবাজারের মুনাফার বেশির ভাগ টাকা আসলে চলে গেছে মুদ্রাবাজারে। গত বছর ব্যাংকগুলোর মুনাফার সিংহভাগই আসে পুঁজিবাজার থেকে। আলাদা কম্পানি হওয়ার আগ পর্যন্ত মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো বেশ কিছু সুবিধা ভোগ করে। ফলে নিজেদের চ্যানেল থেকে তারা নিজেদের ডিলার অ্যাকাউন্টে ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পোর্টফোলিওতে মার্জিন ঋণের মাধ্যমে ব্যাপক হারে বিনিয়োগ করে। সেখান থেকেই মুনাফা আসে ব্যাপক। কোনো কোনো মার্চেন্ট ব্যাংক ২০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করে। কিন্তু ডিসেম্বরের পরে আলাদা সাবসিডিয়ারি কম্পানি করার পর এসব ব্যাংকের ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগের সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। একই সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েকটি সার্কুলার জারি করে। ফলে কমে যায় ব্যাংকের বিনিয়োগ। এর প্রভাব পড়ে পুঁজিবাজারে। বিভিন্ন সূত্র মতে, শেয়ারবাজারের কিছু সংঘবদ্ধ চক্রও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি নিজেদের অর্থ তুলে নেয়। ফলে বাজার হয়ে পড়ে অর্থশূন্য।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সভাপতি শাকিল রিজভী গত বৃহস্পতিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, পুঁজিবাজারের বেশির ভাগ টাকা চলে গেছে মুদ্রাবাজারে। আর একটি অংশ তুলে নিয়েছে কারসাজি চক্র। ২০ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলন থেকে তিনি এ চক্রের বিরুদ্ধে তদন্তের দাবি করেন।
কারণ আরো আছে : নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসির কয়েকটি সিদ্ধান্তের প্রভাবেও এ পতন ত্বরান্বিত হয় বলে মনে করা হচ্ছে। এ ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বার্ষিক হিসাব সমাপনী (ইয়ার ক্লোজিং), আইনসীমার অতিরিক্ত অর্থ প্রত্যাহারে বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোরতা আরোপ, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা শিল্পঋণের টাকা ফেরতের সময় বেঁধে দেওয়া, ব্যাংকের নগদ জমা সংরক্ষণের (সিআরআর) হার বৃদ্ধি এবং মার্জিন ঋণ সংকোচন করার প্রভাবও পড়ে বাজারে। এদিকে ডিসেম্বরের মধ্যে ব্যাংকগুলোর মার্চেন্ট ইউনিটকে আলাদা সাবসিডিয়ারি কম্পানি করা হয়েছে। ব্যাংকিং নিয়ম অনুযায়ী পরিশোধিত মূলধনের ১৫ শতাংশের বেশি কোনো কম্পানিকে ঋণ দেওয়ার নিয়ম নেই। ফলে তারাও বিনিয়োগ আর বাড়াতে পারছে না।
ডিএসইর সভাপতি এ প্রসঙ্গে কালের কণ্ঠকে বলেন, একসঙ্গে এতগুলো সিদ্ধান্ত আরোপের কারণেও বাজার অস্থিতিশীল হয়েছে।
কাগুজে বনাম ইলেকট্রনিকস : ১৯৯৬ সালে অল্প কয়েক দিনের মধ্যে কৃত্রিমভাবে কয়েকটি কম্পানির শেয়ারের দাম বাড়িয়ে তা বিক্রি করে বাজার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। ১৯৯৬ সালে ছিল কাগুজে শেয়ার, এবার ইলেকট্রনিক শেয়ার। এবার এক বছর ধরে শেয়ারের দাম বাড়ার ঘটনা ঘটে। বাজার থেকে সরে পড়তে সময় নিয়েছে প্রায় এক মাস। তবে এবারের ভয়াবহ ঘটনা হচ্ছে, স্বেচ্ছায় লোকসান দিয়ে বাজারদরের চেয়ে অনেক কম দামে শেয়ার বিক্রির করে দেওয়া, যা গত বৃহস্পতিবার ধরা পড়েছে কর্তৃপক্ষের নজরদারিতেও।
১৯৯৬ সালে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ছিল ১০ হাজার। আর দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাধারণ মূল্যসূচক ছিল ২০০০ পয়েন্ট। গড়ে প্রতিদিনের লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৩০০ কোটি টাকা। কম্পানির সংখ্যাও ছিল কম। এবার বিও অ্যাকাউন্টধারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৩ লাখ। মূল্যসূচক ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে সর্বোচ্চ ৮৯০০ পয়েন্টে ওঠে। ডিএসইতে প্রতিদিনের লেনদেনের গড় দাঁড়ায় প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। বাজার মূলধনের পরিমাণ তিন লাখ পাঁচ হাজার কোটির ওপরে ওঠে। তবে বাজারে ধারাবাহিক পতনের ফলে গড় লেনদেন ও বাজার মূলধন দুই-ই অনেক কমে গেছে।
১৯৯৬ সালের শেয়ার কেলেঙ্কারির ঘটনায় মামলা হলেও এর বিচার হয়নি আজও। আদালতের স্থগিতাদেশের পর বিচার কার্যক্রম থেমে আছে। এ মামলার বিচার কার্যক্রম নিষ্পত্তি করার উদ্দেশ্যে বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে একটি সংসদীয় কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ওই কমিটি এখন পর্যন্ত কোনো কার্যক্রম শুরু করেনি বলে জানা গেছে। তদন্ত কার্যক্রমের দুর্বলতার কারণে এ মামলার পরিণতি নিয়েও দেখা দিয়েছে সংশয়।

No comments:

Post a Comment