Saturday, January 22, 2011

শিক্ষার হার ও মান দুই-ই বাড়াতে হবে by মাহমুদুল বাসার

০১১ সালের প্রথম মাসের প্রথম সপ্তাহেই সরকার শিক্ষাথর্ীদের হাতে বিনামূল্যে পাঠ্যবই তুলে দিয়েছেন। ১৯৭২ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত শুধু প্রাইমারি স্কুলে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত বিনামূল্যে বই দেয়া হত। এবার দেয়া হলো নবম শ্রেণী পর্যন্ত।

নবম শ্রেণীর বই বিতরণ করা মানে এসএসসি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার বই সরকার ছাত্রছাত্রীদের বুঝিয়ে দিলেন। নতুন বই বিনামূল্যে হাতে পেয়ে ছেলে-মেয়েরা কতটা খুশি এবং উলস্নসিত হয়েছে, তা নিজের চোখে দেখেছি। এই চিন্তাটি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মাথায় ছিলো। একজন বিজ্ঞ কলাম লেখক বলেছেন, ১৯৯২ সাল থেকে পদক্ষেপটি নেয়া হয়েছে। না, মোটেও নয়। ১৯৯২ সাল থেকে মেয়েদের অবৈতনিক শিক্ষা এবং উপবৃত্তি প্রদান শুরু হয়, একথা সত্য। ক্রমে তা সম্প্রসারিত হয়। কোনো সরকারই শিক্ষার এই কল্যাণকর নীতিমালাকে সংকুচিত করেনি। এজন্য আমরা সব সরকারকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

তবে বিনামূল্যে বই বিতরণ শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর সরকারের আমলে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত। বর্তমান মহাজোট সরকারের আমলে শুরু হলো নবম শ্রেণী পর্যন্ত বিনামূল্যে পাঠ্যবই দেয়া। ভবিষ্যতে এই পদক্ষেপ আরো সম্প্রসারিত হবে, আশা করতে পারি আমরা। বর্তমান সরকার চেষ্টা চালাচ্ছেন শিক্ষাকে আধুনিক, গণমুখী এবং কর্মমুখী করার জন্য। ইংরেজ সরকার চালু করেছিলো কেরানি তৈরির শিক্ষা ব্যবস্থা। একথা দুঃখের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন। সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছেন, ইংরেজ চেয়েছিলো আমাদের মাছি মারা কেরানি বানাতে। পাকিস্তান সরকার যা চেয়েছিলো তা আর বলে লাভ নেই, আমাদের রক্তঝরা আন্দোলনের ইতিহাসে সে সব লেখা আছে।

সরকার চাচ্ছেন শিক্ষাকে মুখস্থ নির্ভরতা বাতিল করতে। রবীন্দ্রনাথই বলেছেন, পরীক্ষার হলে পেটে করে নেয়া আর পকেটে করে নেয়া একই কথা। দুটোই নকল। তাই ছাত্র-ছাত্রীরা বুঝে উপলব্ধি করে, আয়ত্ত করে, বার বার রিডিং পড়ে গভীরভাবে ধারণা নিয়ে নিজস্ব ক্ষমতা দিয়ে প্রশ্নের উত্তর লিখবে। তাই আমাদের বিদ্বান এবং শিক্ষানীতির চিন্তকরা চেষ্টা করছেন মুখস্থবিদ্যাকে নিশ্চিহ্ন করতে।

বর্তমান সরকার যে মাধ্যমিক পর্যন্ত পরীক্ষার তিনটি স্তরের চূড়ান্ত ব্যবস্থা করেছেন, এটা একটা কাজের কাজ করেছেন। এতে শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত মানোন্নয়ন ঘটবে। অতীতে এই সিস্টেম না থাকাতে গোঁজামিল দিয়ে, ফাঁকি দিয়ে, চৌর্যবৃত্তির মাধ্যমে জাতি ভুয়া এসএসসি উত্তীর্ণ প্রজন্ম পেয়েছে। এই সিস্টেমে ৫ম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষায় উন্মোচন ঘটবে একজন শিক্ষাথর্ীর সার্বিক অবস্থান। ৫ম শ্রেণী ঠিকমত পার হলে, ৮ম শ্রেণীও ঠিকমত পার হতে পারবে, মাধ্যমিকে যেয়ে আরো পরিপক্ব হয়ে উত্তীর্ণ হবে। উচ্চ মাধ্যমিকে যেয়ে একজন শিক্ষাথর্ী পরিপূর্ণ মেধাবী হয়ে উঠবে সহজভাবে। কিন্তু এই তিনটি স্তরের চূড়ান্ত পরীক্ষা না থাকলে শিক্ষাথর্ীর ভেতরে আধাসেদ্ধ মাংসের মত আধাশিক্ষার গোঁজামিল থেকে যেতো। আমরা চাই, শিক্ষিত মুর্খ, ফাঁকিবাজরা ৫ম শ্রেণীতে ঝরে যাক। একটি জাতীয় পত্রিকায় দেখলাম, 'উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে ১৯ প্রকল্পে অর্থায়ন করবে সরকার'। এই প্রতিবেদনে পেলাম, দেশের উচ্চ শিক্ষার মানোন্নয়নে ৬৮১ কোটি টাকা ব্যয়ে ৯১টি প্রকল্পভিত্তিক গবেষণা করবে সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, শিক্ষার মানোন্নয়নে গবেষণার বিকল্প নেই। শিক্ষা নিয়ে অনেক ভাবনার বিষয় আছে। শিক্ষা নিয়ে ভেবেছেন রাজা রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরী, মনীষী মোতাহের হোসেন চৌধুরী প্রমুখ বাঙালি। তাদের ভাবনাগুলো আমাদের সামনে থাকলে ভালো হয়। তারা তাদের সময়ে যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা চেয়েছিলেন। আমরাও চাই যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা।

বিদ্যাসাগর শাস্ত্র নির্ভর শিক্ষা চাননি, রবীন্দ্রনাথ চাননি ইংরেজি নির্ভর শিক্ষা, মোতাহের হোসেন চৌধুরী চাননি অমানবিক শিক্ষা। এসব দৃষ্টিভঙ্গিতো আমরা উপেক্ষা করতে পারি না। শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন যে, ৫ম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষা নিয়ে বুঝতে পারলাম, গ্রামেও মেধা আছে। তাদের বিকাশের সুযোগ করে দিতে হবে। এটা পারে শুধু বৈষম্যহীন শিক্ষানীতি। সরকার মনে-প্রাণে চাচ্ছেন না যে, শিক্ষাকে পণ্যের মত বাজার থেকে কিনে নিয়ে যাক বিত্তবানরা।

বর্তমান শিক্ষামন্ত্রীকে ভাবতে হবে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই যাতে শিক্ষকরা শিক্ষাথর্ীদের পড়া আদায় করে নেন একজন ধাত্রীর মত। একটি গরিব পরিবারের সন্তানকে গণিত, জ্যামিতি, ইংরেজি, বাংলা, ব্যাকরণ, বানান কৌশল শেখাবে? তার মা, বাবা, বড় ভাই যদি হয় নিরেট নিরক্ষর; যদি তার প্রাইভেট টিউটর রাখার সামর্থ্য না থাকে, তাহলে ঐসব টেকনিক্যাল বিষয়গুলো। হাতে ধরে কে শেখাবে? এই প্রশ্ন মাথায় রেখে, যারা শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা করছেন সরকারি অর্থায়নে, তাদের সমাধানের পথ বাতলে দিতে হবে। ব্যবস্থা করতে হবে গরিবের সন্তান যেনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই শিক্ষাটা পায়। তাতেই দেশ উপকৃত হবে। মনে রাখা দরকার : শিক্ষার মান যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি শিক্ষার হারও বাড়াতে হবে। দেশের প্রতিটি নাগরিক যদি সুশিক্ষিত হয়, দক্ষ জনশক্তি হয়, তাহলেই দেশের উন্নতি হবে। সুসাহিত্যিক ডাঃ লুৎফর রহমান বলেছেন, শতকরা ৫ জন উচ্চশিক্ষিত হয়ে লাভ কী দেশের? কথাটা মনে রাখা জরুরি।

No comments:

Post a Comment