Saturday, January 22, 2011

রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় ও রবীন্দ্র একাডেমি কতদূর? by ড. সৌমিত্র শেখর

মরা যারা দীর্ঘদিন ধরে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় ও রবীন্দ্র একাডেমি প্রতিষ্ঠার জন্য লিখছিলাম, দাবি জানিয়ে আসছিলাম, আন্তরিকভাবে কামনা করছিলাম তাদের সবাইকে খুশি করেছে গত পঁচিশে বৈশাখে প্রদত্ত মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা।

তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারিভাবে রবীন্দ্র একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা হবে। এর চেয়ে খুশির সংবাদ আর কী হতে পারে ? এ বছর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী। এ মাহেন্দ্র ক্ষণ আর আসবে না। রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থাকার পরও পশ্চিমবঙ্গ সরকার রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষে (১৯৬১) সেখানে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশত জন্মবার্ষিকীতে বাংলাদেশে তাঁর নামাঙ্কিত একটি বিশ্ববিদ্যালয় ও একাডেমি স্থাপিত হলে সেটাও ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর প্রায় বছর ঘুরতে চলল।

ইতোমধ্যে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ উদ্যোগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী পালনের ঘোষণা এসেছে। আশ্চর্য! এই ঘোষণার পর মনে হচ্ছে, সারা বাংলাদেশ রবীন্দ্রনাথ নিয়ে অনুষ্ঠান করার স্পৃহা যেন হারিয়ে ফেলেছে (একমাত্র ব্যতিক্রম ছায়ানট)। কেন এমনটি হলো বোঝা মুশকিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরম্ভ করে দেশের আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয় রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সৃষ্টিকর্মের উপর কোনো অনুষ্ঠান বা সভা-সেমিনার করেছে বা অদূর ভবিষ্যতে করবে বলে আমাদের কাছে খবর নেই। অথচ, এ বছর আন্তর্জাতিক মানের সেমিনার আয়োজন করা উচিত। আমি নিজে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও বেজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে সেখানে রবীন্দ্রনাথের উপর অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশ নিয়ে এসেছি। সারাবিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দেশসমূহে যে বছর রবীন্দ্রনাথের উপর নানা আয়োজন চলছে, সে বছর শুধু বাংলাদেশ-ভারত যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠান হবে_ এই কথা বলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে নিজেদের দায় থেকে মুক্তির উপায় নেই। দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানসমূহের উচিত হবে এ বছরটাকে রাঙিয়ে দেয়া_ পুরো বছর রবীন্দ্রময় করে তোলা। দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথের উপর সভা-সেমিনার-গবেষণা করা তাই বাঞ্ছনীয় হবে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ উদ্যোগে যে অনুষ্ঠান হবে তাতে জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে পত্র-পত্রিকায় দেখেছি। প্রথমে একশজনের নামের তালিকা প্রকাশিত হয়েছে, পরে নাকি আরো পঞ্চাশজনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কারা এ কমিটির নাম প্রস্তাব করেছেন আমি জানি না। তবে ধারণা করি, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমেই বিষয়টি অনুমোদন পেয়েছে। আমার ধারণা যদি সত্য হয়, তাহলে বলবো, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় দেশের সংস্কৃতির ঠিকঠাক খবর জানে না। কোন্ ব্যক্তি কোন্ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ বা কার আগ্রহ কী নিয়ে নাম প্রস্তাবের আগে এটা তাদের ভেবে দেখা উচিত ছিল। একটি 'গড় কমিটি' গঠন করলেই দায়িত্ব সুচারুভাবে পালিত হয়েছে তা বলতে পারছি না। আমার এ কথা বলার যৌক্তিক কারণ আছে। আমি জানি, বাংলাদেশের প্রধান প্রধান রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞদের অনেকেই এ জাতীয় কমিটির বাইরে আছেন। সারা জীবন যাঁরা রবীন্দ্রনাথ নিয়ে কাজ করেছেন, তাঁকে নিয়ে ভেবেছেন, বিপদ-আপদের সময় সব ছেড়েছেন কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে ছাড়েননি তাঁদের রাখা হলো না কেন এ কমিটিতে? অথচ এ কমিটিতে স্থান পেয়েছেন এমন অনেকে যাঁরা রবীন্দ্রনাথের উপর সারা জীবনেও তেমন ভাবেননি। অনেকের আত্মীয়-স্বজনও কমিটিতে আছেন। অনেকে আবার তথাকথিত 'সর্ববিশেষজ্ঞ' হিসেবে আছেন। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, ফররুখ, তালিম হোসেন_ যাঁর উপর কমিটিই হোক-না কেন, এঁরা থাকেনই। আর রাজনীতির বিবেচনাতেও অনেকে প্রবেশ করেছেন এই কমিটিতে_ কিছু নাম দেখে তেমনি বোধ হচ্ছে। তাই 'সভা হচ্ছে' এমন সংবাদ পেয়ে যখন কমিটির সদস্যদের কাছে সভার সিদ্ধান্ত জানতে আগ্রহ প্রকাশ করি, তখন তারা যে সিদ্ধান্তের কথা শোনান তাতে জমকালো গান-বাজনা, কিছু লোকের ভারত ভ্রমণ ছাড়া আর কিছু হবে বলে বিশ্বাস হয় না। আর এ কারণেই সন্দেহ থেকে যায়, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা সত্ত্বেও দেশে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় ও রবীন্দ্র একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হবে কি-না! আমার এ সন্দেহের আর একটি কারণ হলো, এখনও রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের স্থানটি নির্দিষ্ট হয়নি। কুষ্টিয়াতে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। তাছাড়া শিলাইদহ কুঠিবাড়িটিও নদীর অপর পাড়ে বলে সেখানে যোগাযোগ কষ্টসাধ্য। অন্যদিকে সিরাজগঞ্জ জেলায় কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই। শাহজাদপুর কুঠিবাড়ি সুযোগাযোগ ব্যবস্থাসম্পন্ন। এ কারণে সহজেই শাহজাদপুর রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার স্থান নির্বাচনের ঘোষণা দেয়া যেতে পারে। আর ঢাকায় রবীন্দ্র একাডেমি স্থাপনের উদ্যোগ নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বাস্তবায়নের সূচনা করা খুবই সম্ভব। মনে রাখতে হবে, আগামী মে মাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী পূর্ণ হয়ে যাবে। এর পর সব আয়োজনই গুরুত্ব হারাবে।

No comments:

Post a Comment