Wednesday, January 12, 2011

৪০ হাজারের বেশি কারখানাঃ বিপুল সম্ভাবনার হাতছানি

ষ্ট যন্ত্র বা যন্ত্রাংশের মতো হুবহু আরেকটি যন্ত্র বা যন্ত্রাংশ তৈরিতে প্রয়োজন একই গুণাগুণসম্পন্ন লোহা। লোহায় কার্বন বা অন্যান্য উপাদানের পরিমাণ কত, তা জানতে প্রয়োজন হয় গবেষণাগারে পরীক্ষার। কিন্তু ধোলাইখালের কারিগরদের কোনো গবেষণাগার নেই।

তাঁরা লোহার টুকরোটা ওপরে ছুড়ে মারেন। সেটা নিচে পড়ার পর শব্দ শুনেই 'স্বশিক্ষিত' দক্ষ কারিগররা বুঝে ফেলেন লোহার গুণাগুণ। আবার নমুনা যন্ত্র কাটার সময় আগুনের যে স্ফুলিঙ্গ তৈরি হয়, তার লাল-নীল রং দেখেই বুঝে নেন তাতে কার্বনের মাত্রা কত।
এভাবেই অভিজ্ঞতা, দক্ষতা আর মেধাকে পুঁজি করে শূন্য থেকে মহীরুহে পরিণত হয়েছে দেশের 'হালকা প্রকৌশল শিল্প' খাত। ভাঙা জাহাজের পুরনো লোহা দিয়ে তারা তৈরি করছে দামি সব যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ। সেসব যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ সংযোজন করেই চলছে দেশের ছোট-বড় বিভিন্ন ধরনের কলকারখানা, বাইসাইকেল থেকে রেলগাড়ি পর্যন্ত।
পুরান ঢাকার ধোলাইখালসহ দেশের কয়েকটি জায়গার উদ্যোক্তা ও কারিগরদের এমন অভিনব উদ্ভাবনী ক্ষমতার বহু নজির রয়েছে।
কিন্তু খরচ বেশি হওয়ায় গবেষণা ও উন্নয়নের (আরঅ্যান্ডডি) দিকে মন দিতে পারছেন না এ শিল্পের উদ্যোক্তারা। তাঁরা বরং রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে (অন্যকে অনুসরণ) দক্ষ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ শিল্পকৌশল প্রচলিত। এ প্রসঙ্গে একজন উদ্যোক্তা বলেন, 'এ শিল্পে করপোরেট বিনিয়োগ না থাকায় আরঅ্যান্ডডি সম্ভব হচ্ছে না। তা ছাড়া নয়া প্রযুক্তি আমদানি করে কাজ করতে গেলেও আমাদের জন্য তা লাভজনক হবে না, বরং ২০ থেকে ৫০ বছরের পুরনো প্রযুক্তি পেলেই আমরা খুশি। তাই আমাদের গবেষণার প্রয়োজন নেই। ভারত, চীনসহ বিভিন্ন দেশ অনেক গবেষণা করছে। আমরা তাদের অনুসরণ করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি।'
এ শিল্পের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্বাধীনতার আগে ঢাকার ধোলাইখালে বিহারি ও পাঞ্জাবি মালিকরা গাড়ি মেরামতের জন্য সাত-আটটি ওয়ার্কশপ গড়ে তুলেছিলেন। ওই সময় সারা দেশে এ ধরনের মেরামত কারখানা ছিল ৫০টিরও কম। তখন এসব কারখানায় যাঁরা শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন, স্বাধীনতার পর তাঁরাই উদ্যোক্তা হয়ে নতুন নতুন ওয়ার্কশপ গড়ে তোলেন। তৈরি করেন নানা ধরনের যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ। কিন্তু এ পর্যন্ত এ খাতের উদ্যোক্তারা সরকারের কাছ থেকে কার্যত কোনো সহায়তা পাচ্ছেন না। প্রয়োজন পড়েনি ব্যাংক ঋণেরও। পোশাক খাতসহ
অন্যান্য শিল্পের মতো এ খাতের উদ্যোক্তাদের সমিতি দল বেঁধে যেমন সরকারের কাছে দাবিনামা তুলে ধরেনি, তেমনি সরকারগুলোও কোনো অনুকম্পা দেখায়নি এ খাতের বিকাশে। তা সত্ত্বেও দেশের চাহিদার প্রায় ৫০ শতাংশ পূরণ করে বিদেশেও রপ্তানি করছেন এ শিল্পের উদ্যোক্তারা। আর দেশের বাজারে এ শিল্পের এতটাই চাহিদা যে, ক্রেতারা প্রায়ই যন্ত্রাংশ তৈরির জন্য উদ্যোক্তাদের অগ্রিম অর্থ দিয়ে বুকিং দিয়ে রাখেন।
হালকা প্রকৌশল শিল্পমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্ডাস্ট্রিজ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিইআইওএ) সভাপতি আবদুর রাজ্জাক কালের কণ্ঠকে বলেন, এ শিল্পে সারা দেশে গড়ে উঠেছে ৪০ হাজারেরও বেশি কারখানা। এর মধ্যে ৩৬ হাজার প্রতিষ্ঠান রিপেয়ারিং সার্ভিসিং করে থাকে। বাকি প্রায় চার হাজার কারখানা নতুন যন্ত্র উৎপাদন করে। অথচ পুরো সেক্টরে ৫০ জন ইঞ্জিনিয়ারও খুঁজে পাওয়া যাবে না। অদক্ষ, অর্ধশিক্ষিত কারিগরদের হাতেই তৈরি হচ্ছে মূল্যবান সব যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ। তিনি আরো জানান, সরাসরি ছয় লাখ লোক কর্মরত হালকা প্রকৌশল শিল্পে। এ শিল্পে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। বছরে নতুন যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ উৎপাদন হচ্ছে ১২ হাজার কোটি টাকার। ভাঙাচোরা লোহালক্কড় থেকে তৈরি এসব যন্ত্র ও যন্ত্রাংশে মূল্য সংযোজন গড়ে ৮০ শতাংশেরও বেশি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মূল্য সংযোজন হাজার গুণ পর্যন্ত হয়। উৎপাদন ও বিপণনের সঙ্গে মেরামত যোগ করলে এ খাতের বার্ষিক টার্নওভারের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিভিন্ন শিল্প খাত ও পরিবহন সেক্টরের প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশের প্রায় ৫০ শতাংশ সরবরাহ হচ্ছে এ শিল্প থেকে। দুই-আড়াই দশক আগেও এর পুরোটাই ছিল আমদানিনির্ভর। যন্ত্রাংশ ছাড়াও আস্ত নতুন যন্ত্রও তৈরি হচ্ছে ঢাকার ধোলাইখাল, বগুড়া ও যশোরের বিভিন্ন কারখানায়। এসব রপ্তানিও হচ্ছে। প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৩০ কোটি ডলার আয় হচ্ছে এ খাতের রপ্তানি থেকে। জিডিপিতে এ শিল্পের অবদান প্রায় ২ শতাংশ বলে বিইআইওএ জানায়। তাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশ বছরে সাত কোটি ৪০ লাখ ডলারের গাড়ির যন্ত্রাংশ আমদানি করে। আর হালকা প্রকৌশল শিল্প থেকেই দেশের বাজারে সরবরাহ করা হয় সাত কোটি ৫০ লাখ ডলারের যন্ত্রাংশ।
ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি), ইউকে ডিপার্টমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ও নরওয়ে সরকারের সহযোগিতায় সাম্প্রতিক এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৫০ হাজার অতি ছোট এবং ১০ হাজার ক্ষুদ্র ও মাঝারি আয়তনের হালকা প্রকৌশল শিল্পে কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা ছয় লাখ। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অন্য এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, এ শিল্পে কারখানার সংখ্যা ৪০ হাজার আর কর্মরত শ্রমিক আট লাখ।
হালকা প্রকৌশল শিল্পে প্রায় ৩ হাজার ৮০০ রকমের যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ তৈরি হচ্ছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনে (বিসিক) নিবন্ধিত এক হাজার ২০০ উদ্যোক্তা বিভিন্ন সরকারি-আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানে সাবকন্ট্রাক্টের মাধ্যমে যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ সরবরাহ করছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে রেলওয়ে, তিতাস, বাখরাবাদ ও জালালাবাদ গ্যাস কম্পানি, চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডাব্লিউটিএ), বন্দর কর্তৃপক্ষ, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, সিভিল এভিয়েশন, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি), বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশন (বিটিএমসি), বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন (বিজিএমসি) ইত্যাদি। যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ তৈরি করা ছাড়াও মেরামতের প্রায় ৮০ শতাংশ কাজই করছেন এ শিল্পের উদ্যোক্তারা।
বিইআইওএর সভাপতি আবদুর রাজ্জাক, নিপুণ ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের মালিক আবুল হাশিম, দিদার ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী বাচ্চু মিয়াসহ বিভিন্ন উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্বাধীনতার আগে হালকা প্রকৌশল শিল্পে বাঙালিদের তেমন অবদান ছিল না। বিহারি ও পাঞ্জাবি উদ্যোক্তাদের হাতে ঢাকার ধোলাইখালে ইউনাইটেড ইঞ্জিনিয়ারিং, মডেল ইঞ্জিনিয়ারিং, বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং, ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারিং ও মমিন ওয়ার্কশপ গড়ে ওঠে। অবাঙালিদের এসব প্রতিষ্ঠানে পুরান ঢাকার মানুষ শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করে। ওই সময় পাটকলের যন্ত্রাংশ তৈরি করত চট্টগ্রামের ইস্পাহানি ও গালফ হাবিব নামের দুটি প্রতিষ্ঠান। উত্তরাঞ্চলের যানবাহনের যন্ত্রাংশ তৈরি ও মেরামতের জন্য রংপুরে একটি ওয়ার্কশপ ছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক্কালে কারখানার মালিকরা শ্রমিকদের হাতে দায়িত্ব দিয়ে দেশ ছাড়েন। তাঁদের অনেকে এখনো সেসব কারখানা চালাচ্ছেন। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় ইস্পাহানি ও গালফ হাবিব বন্ধ হয়ে যায়। যুদ্ধের পর পাটকলগুলো থেকে বিপুল পরিমাণ যন্ত্রাংশের অর্ডার আসতে থাকে ঢাকার ধোলাইখালের কারখানাগুলোতে। আগে থেকে ধোলাইখালে কাজ করা শ্রমিকরা তখন নতুন নতুন ওয়ার্কশপ স্থাপন করে যন্ত্রাংশ তৈরির কাজ শুরু করেন।
আবদুর রাজ্জাক বলেন, এ শিল্পে সরকারের তেমন কোনো সহযোগিতা নেই। শুল্কমুক্তভাবে কাঁচামাল ও প্রযুক্তি আমদানি, স্থানীয় বাজার থেকে কাঁচামাল সংগ্রহের ক্ষেত্রে ভ্যাট মওকুফ করা কিংবা নিজেদের উৎপাদিত যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ বিপণনেও ভ্যাট অব্যাহতি মেলেনি। ফলে ১০০-২০০ বছরের পুরনো হস্তচালিত মেশিনেই যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ তৈরি করতে হচ্ছে। দু-তিন বছর আগে কেবল রপ্তানি আয়ের ওপর ১০ শতাংশ হারে প্রণোদনা ঘোষণা করে সরকার। তাতে এ খাতের ব্যবসায়ীরা সব মিলিয়ে বছরে পান মাত্র ৫০-৬০ লাখ টাকা।
উদ্যোক্তাদের আরেকটি দাবি, কৃষি ও আইটি খাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের যে বিনা সুদে ঋণের তহবিল (ইইএফ ফান্ড) আছে, সেখানে হালকা প্রকৌশল শিল্পকেও অন্তর্ভুক্ত করা হোক বা ওই তহবিলের মতো এ শিল্পের জন্যও একটি তহবিল গঠন করা হোক।
শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়ার কাছে জানতে চাওয়া হলে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, 'দেশে হালকা প্রকৌশল শিল্প থেকে বড় কিছু গড়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। আমরা এটা খুবই গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। শিল্পনীতিতে ছোট, মধ্য ও বড় কারখানা গড়ে তোলার যে পরিকল্পনা আছে, সেখানে এ শিল্পকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। এমনকি হালকা প্রকৌশল শিল্পপল্লী গড়ে তোলার পরিকল্পনাও সরকারের আছে।'

No comments:

Post a Comment