Wednesday, January 12, 2011

জলদস্যুর কবলে ভয়-আশার ৮ মাস by মিঠুন চৌধুরী

সোমালীয় জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্ত দুই বাংলাদেশি নাবিকের একজন ছিলেন মৃত্যুভয়ে, অন্যজন ছিলেন ফেরার ব্যাপারে আশাবাদী। নাবিক জাফর ইকবাল বলেছেন, আট মাসের প্রতিটি দিন কেটেছে মৃত্যুভয়ে। অন্যদিকে দেশে ফেরার বিষয়ে আশাবাদী ছিলেন নাবিক গিয়াসউদ্দিন আজম খান। তিনি বলেছেন, টাকা পেলেই ওরা বন্দিদের ছেড়ে দেয়। তাই দেশে ফেরার বিষয়ে কোন সন্দেহ ছিল না।

সোমালি জলদস্যুদের হাত থেকে মুক্ত এই দুই নাবিক পৃথকভাবে মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে জাহাজ ছিনতাই ঘটনার বর্ণনা দেন। চট্টগ্রাম নগরীর সুগন্ধা আবাসিক এলাকায় নিজ বাসায় বসে ঘটনার বর্ণনা দেন জাফর ইকবাল। আর মেহেদীবাগ সিডিএ আবাসিক এলাকার বাসায় কথা বলেন গিয়াসউদ্দিন আজম খান।

'এমভি মারিয়া মার্গারেট' নামের জার্মান পতাকাবাহী জাহাজের প্রধান কর্মকর্তা জাফর ইকবাল সোমবার বিকালে দেশে ফেরেন। এর আগে ৮ জানুয়ারি ওমানের মালাল থেকে দেশে ফেরেন জাহাজের দ্বিতীয় প্রকৌশলী গিয়াসউদ্দিন আজম খান। তারা সোমালি জলদস্যুদের হাত থেকে এক সঙ্গেই মুক্তি পেয়েছেন। তাদের দুজনের বাড়িই চট্টগ্রামে।

জাফর ইকবাল বলেন, "গত বছর ৫ মে আমরা ভারত কানলা বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করি। ৮ মে সকালে এডেন উপসাগরে পৌঁছানোর পর রাডারে আমাদের অনুসরণকারী একটি স্পিড বোট দেখতে পাই।" "সাথে সাথে এডেন সাগরে নিরাপত্তায় নিয়োজিত আইএমও এবং ন্যাটোর যৌথ টহল দলের ওয়ারশিপ ও হেলিকপ্টারে খবর দিই। কিন্তু ১৫ মিনিটের মধ্যে আমাদের জাহাজের কাছে এসে পৌঁছে জলদস্যুদের স্পিড বোটটি।"

জাফর ইকবাল জানান, "ভারি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অ্যালুমিনিয়ামের মই (ল্যাডার) দিয়ে জাহাজে উঠে পড়ে ছয় জলদস্যু। এর আগে রকেট লঞ্চারে গোলা ছুড়ে জাহাজের গতিপথ পরিবর্তনে বাধ্য করে তারা।"

সোমালি জলদস্যুরা জাহাজটি ছিনতাই করে এর মোট ২২ জন নাবিককে জিম্মি করে ফেলে। এই ২২ নাবিকের মধ্যে কেবল জাফর ইকবাল ও গিয়াসউদ্দিন আজম খান বাংলাদেশের নাগরিক। গত ২৮ ডিসেম্বর মুক্তিপণের বিনিময়ে ২২ নাবিকসহ জাহাজ মারিয়া মার্গারেটকে ছেড়ে দেয় জলদস্যুরা। জাফর ইকবাল জানান, "ছিনতাই হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই উদ্ধারকারী হেলিকপ্টার থেকে 'মারিয়া মার্গারেট' এর ক্যাপ্টেনের সাথে যোগাযোগ করা হয়। তবে ততক্ষণে জলদস্যুদের আগ্নেয়াস্ত্রের সামনে জাহাজের চার কর্মকর্তা। জাহাজ চলতে শুরু করেছে সোমালিয়া উপকূলের দিকে।

মৃত্যু ভয়ের মুখোমুখি আট মাস
দীর্ঘ আটমাস সোমালি জলদস্যুদের হাতে বন্দি ছিলেন 'মারিয়া মার্গারেট' এর ২২ নাবিক। প্রথম চার মাস জাহাজের চার কর্মকর্তাকে ব্রিজে ও বাকিদের নিচের কেবিনে আটকে রাখা হয়েছিল। পরে সবাইকে নিয়ে আসা হয় ব্রিজে।

জাফর ইকবাল জানান, "ক্যাপ্টেন, প্রধান প্রকৌশলী, দ্বিতীয় প্রকৌশলী ও প্রধান কর্মকর্তা সব সময় থাকতেন জলদস্যুদের তাক করা বন্দুকের মুখে। জলদস্যুদের সবার কাঁধে থাকত একে-৪৭ রাইফেল বা মেশিনগান আর দুই পকেটে দুটি করে রিভলবার।" যে কোন সময় ট্রিগারে চাপ পড়লে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার আশঙ্কা ছিল উল্লেখ করে জাফর ইকবাল বলেন, "আট মাসের প্রতিটি দিন ছিলাম মৃত্যু ভয়ে।"

জাহাজে সবসময় কমপক্ষে ৫০ জন জলদস্যু থাকত জানিয়ে জাফর ইকবাল বলেন, "অন্য কোন জলদস্যু দল বা উদ্ধারকারী দল হামলা চালাতে পারে এ ভয়ে সার্বক্ষণিক কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখত তারা। আর আমাদের সময় কাটত আড্ডা দিয়ে।'

তারা জানান, জাহাজ ছিনতাইয়ে নিয়োজিত জলদস্যুদের বেশিরভাগই পেশায় জেলে। জলদস্যুরা ছিনতাই কাজের জন্য 'গর্ববোধ' করে জানিয়ে জাফর ইকবাল বলেন, "তাদের কাছে এটা আর দশটা পেশার মতই। কোন অপরাধ নয়।"

মুক্তিপণের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই মুক্তি
জলদস্যুরা কখনোই বন্দি নাবিকদের সাথে খারাপ ব্যবহার করে নি। জাহাজে খাবার শেষ হয়ে গেলে তারা খাবার সরবরাহ শুরু করে। তাজা শাক-সবজির পাশাপাশি নিয়মিত ছাগল জবাই করে মাংস দেওয়া হতো বলে জানান জাফর ইকবাল।

দ্বিতীয় প্রকৌশলী গিয়াস উদ্দিন জানান, "গত ২৭ ডিসেম্বর সকালে জাহাজের মালিকপক্ষ জলদস্যুদের কাছে মুক্তিপণের ৫৫ লাখ মার্কিন ডলার পৌঁছে দেয়। পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ২৮ ডিসেম্বর জাহাজের ২২ নাবিকসহ জাহাজটি ছেড়ে দেয় তারা।"

'চার নটিক্যাল মাইল দূরে এমভি জাহান মনি'

গত ৫ ডিসেম্বর ভারত মহাসাগরে ছিনতাই হয় বাংলাদেশি জাহাজ এমভি জাহান মনি। ২৬ বাংলাদেশীসহ জাহাজটিকে সোমালিয়ায় নিয়ে গেছে জলদস্যুরা।

জাফর ইকবাল বলেন, "গারাকাডে যেখানে আমাদের জাহাজটি রাখা হয়েছিল সেখান থেকে চার নটিক্যাল মাইল দূরে রাখা হয়েছে জাহান মনিকে।" মুক্তি পাওয়ার ১৫ দিন আগে জলদস্যুদের অনুরোধ করে স্যাটেলাইট টেলিফোনে জাহান মনির প্রধান কর্মকর্তার সাথে কথা হয় জাফরের। তিনি জানান, "তার সাথে কথা বলে জেনেছি, জাহান মনির সবাই ভাল আছেন। তবে তাদের খাবারের মজুদ শেষ পর্যায়ে ছিল।'

এমভি জাহান মনি এবং এমভি মারিয়া মার্গারেট জাহাজ দুটির ছিনতাইকারী জলদস্যুরা আলাদা গ্র"পের হলেও তাদের মধ্যে যোগাযোগ রয়েছে বলে জাফর ইকবাল দাবি করেন। তারা মুক্তি পাওয়ার আগ পর্যন্ত এই জলদস্যু গ্র"পের অধীনে আটটি ছিনতাইকৃত জাহাজ ছিল।

'জাহাজের নিরাপত্তায় প্রয়োজন সেনা প্রহরা'
ছিনতাই করা জাহাজ নিয়েই অন্য জাহাজ ছিনতাই করে সোমালি জলদস্যুরা। তাই উদ্ধারকারী জাহাজ বা হেলিকপ্টার জলদস্যুদের উপর হামলা চালাতে পারে না। মুক্ত দুই নাবিক জানান, ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশনের (আইএমও) উচিত ভারত মহাসাগর এলাকা অতিক্রমের সময় জাহাজে সশস্ত্র নিরাপত্তা প্রহরী রাখার অনুমতি দেওয়া।

তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, এডেন উপসাগরে একটি 'আন্তর্জাতিক ট্রানজিট করিডোর' আছে। একসাথে পাঁচ থেকে ছয়টি জাহাজ ওই এলাকা পার হয়। এসময় আইএমও এবং ন্যাটোর যুদ্ধজাহাজ ও হেলিকপ্টার যৌথভাবে জাহাজগুলোকে পাহারা দেয়।" ওই করিডোরে পৌঁছানোর ঠিক আগ মুহূর্তে মারিয়া মার্গারেট ছিনতাই হয় বলে তারা জানান।

সোমালিয়া উপকূল থেকে দেড় হাজার নটিক্যাল মাইল দূরে ভারত মহাসাগরের অর্ধেক এলাকা এখন ওই দেশের জলদস্যুদের দখলে বলে দাবি করেন গিয়াসউদ্দিন। তিনি বলেন, "ইতিমধ্যে আমাদের জাহাজের মালিকপক্ষ জার্মান সরকারের সাথে যোগাযোগ শুরু করেছে। যাতে ভবিষ্যতে জার্মান পতাকাবাহী কোন জাহাজ ওই এলাকা অতিক্রম করার সময় জার্মান নৌবাহিনীর প্রহরার ব্যবস্থা করা যায়।"

No comments:

Post a Comment