Wednesday, January 12, 2011

নিবিড় পরিচর্যার বদলে মিলছে ন্যূনতম সেবা by শেখ সাবিহা আলম

দেশের কিছু হাসপাতাল বা ক্লিনিকের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট-আইসিইউ) মানুষ প্রত্যাশিত সেবা পাচ্ছে না। এসব কেন্দ্রে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক, নার্স, ওয়ার্ডবয় বা আয়া নেই। অত্যাবশ্যকীয় যন্ত্রপাতিও নেই। বিশেষ সেবা দেওয়ার কথা বলে রোগীর কাছ থেকে এসব প্রতিষ্ঠান প্রচুর অর্থ নিচ্ছে।

রাজধানীর নামী হাসপাতালগুলোতে আইসিইউর দৈনিক খরচ ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। মাঝারি হাসপাতালগুলোতে খরচ ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেছেন, জটিল রোগের চিকিৎসায় ও জরুরি প্রয়োজনে আইসিইউর সেবা নিতে হয়। চিকিৎসকেরাও এই সেবার কথা ব্যবস্থাপত্রে লেখেন। কিন্তু অভিযোগ আছে, খরচ করেও কিছু হাসপাতালে সেবা পাওয়া যায় না।
বারডেম হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন বিভাগের প্রধান মো. ওমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে আইসিইউ একটি ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। আইসিইউগুলো কে কীভাবে চালাচ্ছে, তা সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিয়মিত নজরদারিতে থাকা উচিত।
সরকারি-বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতালে কতগুলো আইসিইউ চালু আছে, তার কোনো পরিসংখ্যান সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে নেই। তবে, আইসিইউ-সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও বিক্রি করে—এমন একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, বর্তমানে ৭০টিরও বেশি প্রতিষ্ঠানে আইসিইউ আছে।
বারডেম হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন বিভাগ ২০০৭ সালে আইসিইউ নিয়ে দেশব্যাপী সমীক্ষা করে (অ্যান অডিট অব ইনটেনসিভ কেয়ার সার্ভিসেস ইন বাংলাদেশ)। তাতে দেখা গেছে, আইসিইউর ৭৫ শতাংশ শয্যার সঙ্গে কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র নেই। ৬০ শতাংশ আইসিইউতে প্রতিটি শয্যার জন্য একজন করে সেবিকা নেই। আর যেসব সেবিকা আছেন, তাঁদের ৬৪ শতাংশের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নেই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) মমতাজ উদ্দিন ভূঞা বলেন, হাসপাতালে আইসিইউ চালু করার জন্য সরকারের অনুমোদনের দরকার হয় না। তিনি বলেন, আইসিইউ পরিচালনা করার নীতিমালা দরকার। সেটি তৈরির চেষ্টা চলছে।
আইসিইউতে কী কী থাকতে হবে: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, একটি আদর্শ আইসিইউ তৈরির চেষ্টা তারা করছে। কামরুল হুদা ও ইকবাল হোসেইন চৌধুরী (সহযোগী অধ্যাপক, অ্যানেসথেসিয়া, অ্যানালজেসিয়া অ্যান্ড ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিন) আইসিইউর পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন সাত বছর ধরে। তাঁরা জানান, আইসিইউতে রোগীকে ওঠানো-নামানো, কাত করাসহ বিভিন্ন অবস্থানে রাখার জন্য বিশেষায়িত শয্যার দরকার। প্রত্যেক রোগীর জন্য পৃথক ভেন্টিলেটর (কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র) ও কার্ডিয়াক মনিটর (হূদযন্ত্রের অবস্থা, শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা, কার্বন-ডাই অক্সাইড নির্গমনের মাত্রা, শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি, রক্তচাপ পরিমাপক), ইনফিউশন পাম্প (স্যালাইনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মাত্রা নির্ধারণ যন্ত্র) দরকার। আইসিইউতে শক মেশিন (হূদযন্ত্রের গতি হঠাৎ থেমে গেলে তা চালু করার যন্ত্র), সিরিঞ্জ পাম্প (শরীরে ইনজেকশনের মাধ্যমে যে ওষুধ প্রবেশ করানো হয় তার মাত্রা নির্ধারণের যন্ত্র), ব্লাড ওয়ার্মার (রক্ত দেওয়ার আগে শরীরের ভেতরকার তাপমাত্রার সমান করার জন্য ব্যবহূত যন্ত্র) থাকবে। পাশাপাশি কিডনি ডায়ালাইসিস মেশিন, আল্ট্রাসনোগ্রাম, এবিজি মেশিন (মুমূর্ষু রোগীর রক্তে বিভিন্ন উপাদানের মাত্রা নির্ধারণ) থাকতে হবে। তাঁরা বলেন, জরুরি পরীক্ষার জন্য আইসিইউয়ের সঙ্গে একটি পরীক্ষাগার থাকাও আবশ্যক।
বিএসএমএমইউয়ের ১১ শয্যার আইসিইউর জন্য একজন অধ্যাপক, দুজন সহযোগী অধ্যাপক, সাতজন মেডিকেল অফিসার, ৩৫ জন নার্স, ১৬ জন ওয়ার্ডবয় কাজ করেন। দুই ঘণ্টা পরপর প্রতিটি রোগীর অবস্থা জানার ব্যবস্থা রয়েছে। এর বাইরে তিনজন ফিজিওথেরাপিস্ট ও পাঁচজন প্যাথলজি টেকনিশিয়ান এখানে কাজ করেন।
বারডেম হাসপাতালে ১০ শয্যার আইসিইউতে দুজন সার্বক্ষণিক চিকিৎসক, একজন ব্যবস্থাপক চিকিৎসক ও চারজন কনসালটেন্ট আছেন। অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির পাশাপাশি রোগীর অবস্থা ঘণ্টায় ঘণ্টায় পর্যবেক্ষণ করে সেবিকারা লিখে রাখেন।
সেবা বিনা মূল্যের, তাই মান খারাপ: শীর্ষস্থানীয় চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কখনো আইসিইউতে স্থায়ী ভিত্তিতে চিকিৎসক, সেবিকা বা ওয়ার্ডবয় নিয়োগ দেয়নি। আট শয্যার এই কেন্দ্রে প্রতিদিন কমপক্ষে ২৪ জন সেবিকার দরকার। আছেন ১৬ জন।
কর্তব্যরত চিকিৎসক এস এম শফিকুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, চিকিৎসকদের রাজধানীর বাইরের বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে আনা হয়। সেবিকা কম বলে ভেতরে রোগীর আত্মীয়স্বজন ঢুকতে দিতে হয়। এতে নানা ধরনের সংক্রমণ দেখা দেয়।
আইসিইউতে মনিটর মাত্র তিনটি। ফলে সব রোগীর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয় না। এবিজি মেশিনও নেই। একেবারে বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয় বলে হাসপাতালে দরিদ্র অসহায় রোগীরা আসে, কিন্তু তারা প্রাপ্য সেবা পায় না।
পরিচালক শহীদুল হক মল্লিক বলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অর্গানোগ্রামে আইসিইউ ছিল না। সাধারণের চাহিদার কথা বিবেচনা করে এই ইউনিটটি চালু করা হয়। এখন নতুন করে আইসিইউটিকে উন্নত করার সব রকম চেষ্টা চলছে।
ছয় হাসপাতালের দায়িত্বে এক ডাক্তার: মাহমুদুর রহমান এমবিবিএস পাস। তাঁর বিজনেস কার্ডে দেখা যায় তিনি স্নাতকোত্তর চিকিৎসাশিক্ষার ছাত্র। তিনি সাফেনা জেনারেল হাসপাতাল (মালিবাগ), কেয়ারল্যান্ড জেনারেল হাসপাতাল (খিলগাঁও), বাংলাদেশ হার্ট অ্যান্ড চেস্ট হাসপাতাল (ধানমন্ডি), স্পেশাল কেয়ার অ্যান্ড ক্যানসার হাসপাতাল (পশ্চিম পান্থপথ), অগ্রণী হার্ট সেন্টার অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতাল (উত্তরা), কিডনি হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়ালাইসিস সেন্টারে (ধানমন্ডি) আইসিইউ পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন।
মাহমুদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, জটিল প্রয়োজনে হাসপাতালগুলো থেকে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি তাদের সাহায্য করার চেষ্টা করে থাকেন মাত্র।
আইসিইউ চলছে বিশেষজ্ঞ পরামর্শক ছাড়া: প্রতিটি আইসিইউতে বিশেষজ্ঞ বা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক থাকার কথা। কিন্তু বেশির ভাগ হাসপাতালে তা নেই। হাসপাতালগুলোতে কিছু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের নাম ব্যবহার করা হচ্ছে, কিন্তু তাঁরা হাসপাতালে আসেন মাঝেমধ্যে। গ্রীন রোডের ঢাকা রেনাল অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতালের মহাব্যবস্থাপক (বিপণন) বিশ্বজিৎ বৈদ্য জানান, এখানে আইসিইউর বিষয়ে প্রধান পরামর্শক ফজলুর রহমান। ফজলুর রহমান আরও দুটি হাসপাতালে একই কাজ করেন। প্রধানত, হাসপাতালের আইসিইউটি চালান মো. ইউসুফ জামিল।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ইউসুফ জামিল অ্যানেসথেসিয়ার ওপর ডিপ্লোমা ডিগ্রি নিয়েছেন, বিএসএমএমইউয়ের আইসিইউতে ছয় মাসের কাজের অভিজ্ঞতা আছে। তাঁর অধীনে পাঁচ-ছয়জনের একটি দল কাজ করে থাকে। তাদের কারও ডিপ্লোমা ডিগ্রি নেই।
পান্থপথের স্পেশাল কেয়ার হাসপাতালে ২ জানুয়ারি দুপুর ১২টায় কোনো চিকিৎসক পাওয়া যায়নি। হাসপাতালের উপমহাব্যবস্থাপক মিজানুর রহমান বলেন, রোগীর চাপ কম থাকায় চিকিৎসক নেই। রোগী এলেই ফোন করে চিকিৎসক আনা হবে। আইসিইউ পরিচালনা করেন মো. মবিনুল ইসলাম ও তাঁর চার সদস্যের একটি দল। প্রত্যেকেই অন্য হাসপাতালে কাজ করেন। তবে তাঁরা প্রতিষ্ঠানটির উন্নতির জন্য চেষ্টা করছেন বলে জানান।
একই অবস্থা মালিবাগের সাফেনা জেনারেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের। হাসপাতালের আইসিইউ পরিচালনার দায়িত্বে থাকা চিকিৎসক মাহমুদুর রহমান বলেন, প্রয়োজন হলে বিশেষজ্ঞ ডাকা হয়। একজন সার্বক্ষণিক বিশেষজ্ঞের পেছনে প্রচুর ব্যয়।
যন্ত্রপাতির সংকট: ২ জানুয়ারি খিলগাঁওয়ের কেয়ারল্যান্ড জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন হূদরোগে আক্রান্ত এক মুমূর্ষু রোগী। কিন্তু হাসপাতালে কোনো শক মেশিন নেই। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি না থাকলেও রোগী ভর্তি বন্ধ নেই। চার শয্যার আইসিইউতে চারটি ভেন্টিলেটর থাকার কথা, কিন্তু আছে দুটি। এবিজি মেশিন, সিরিঞ্জ পাম্প, ইনফিউশন পাম্প নেই। হাসপাতালে রোগীর জরুরি প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষারও ব্যবস্থা নেই।
যন্ত্রপাতির সংকট আছে স্পেশাল কেয়ার হাসপাতালেও। সাফেনা জেনারেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে আট শয্যার আইসিইউতে চারটি ভেন্টিলেটর। মনিটর, সিরিঞ্জ পাম্প আছে, কিন্তু এবিজি মেশিন নেই।
একজন রোগীকে এসব হাসপাতালকে গড়ে দৈনিক ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা দিতে হয়।
উন্নত সেবা সাধারণের নাগালের বাইরে: কম ব্যয়ে উন্নতমানের সেবা সাধারণ মানুষ পায় বিএসএমএমইউ কিংবা বারডেমে। দুটি হাসপাতালে শয্যাসংখ্যা ২১টি। দিনে খরচ সর্বোচ্চ ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা। মুমূর্ষু রোগীর আত্মীয়স্বজনেরা একটি শয্যার জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা করে।
কিছু বেসরকারি হাসপাতালে সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতি ও পর্যাপ্ত লোকবল আছে। স্কয়ার হাসপাতালে ২১ শয্যার আইসিইউতে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির পাশাপাশি অ্যাম্বুলেন্স ও হেলিকপ্টারে বহনযোগ্য যন্ত্রপাতি আছে। স্কয়ারের সহযোগী পরিচালক (চিকিৎসা) আমের ওয়াহেদ জানান, এখানে রোগীভেদে দৈনিক খরচ ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। রাজধানীর প্রথম শ্রেণীর বেসরকারি হাসপাতালগুলোর বেশির ভাগের চিত্রই এক রকম। তবে এসব হাসপাতালের সেবা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে।

No comments:

Post a Comment