Wednesday, January 12, 2011

বহুতল ভবন, দোকান ও ঝুপড়িঘরে ঘিঞ্জি কক্সবাজার সৈকত

দুই শতাধিক ভবন, অসংখ্য দোকান ও ঝাউবাগানে প্রায় দুই হাজার ঝুপড়িঘর, যা বিশ্বের দীর্ঘতম কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতকে পরিণত করেছে ঘিঞ্জি এলাকায়। সৈকত ঘেঁষে বহুতল আরও ভবন নির্মাণ চলছে। চলছে রাস্তা নির্মাণ। হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ গত সোমবার সৈকতের স্থায়ী-অস্থায়ী সব ধরনের স্থাপনা সাত দিনের মধ্যে উচ্ছেদের জন্য কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দিয়েছেন।
কিন্তু গতকাল মঙ্গলবার এই উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়নি। বরং সৈকতে স্থাপনার নির্মাণকাজ চলতে দেখা গেছে। হাইকোর্ট ওই আদেশে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেছেন। তিন মাসের মধ্যে সমুদ্র সৈকত এলাকার সীমানা নির্ধারণে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করতে জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সৈকত রক্ষায় সেখানে স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ এবং নির্মিত স্থাপনা সরানোর নির্দেশনা চেয়ে জনস্বার্থে করা রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত এসব নির্দেশ দেন।
গতকাল সকালে সৈকতে গিয়ে দেখা যায়, কলাতলী পয়েন্টের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় (সাবমেরিন কেবলের ল্যান্ডিং পয়েন্ট) সৈকতের বুকে রাস্তা তৈরি করা হচ্ছে নির্মাণাধীন সি-ওয়েব লি. হোটেলের মালামাল পরিবহনের জন্য। রাস্তাটি তৈরি করছে সি ওয়েব লি. নামের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। হোটেল সি-ওয়েভ লি.-এর কক্সবাজারের আঞ্চলিক পরিচালক এনামুল হক জানান, পর্যটকদের হাঁটাচলা এবং হোটেলে মালামাল আনা-নেওয়ার সুবিধার্থে রাস্তাটি করা হচ্ছে।
ওই হোটেলের উত্তর পাশে ‘স্বপ্নীল’, ‘ফকির গ্রুপ’, ‘হোটেল বে প্যারাডাইজ’, ‘ডেসটিনি’ ও ‘প্যাসিফিক’ কর্তৃপক্ষও সৈকতের জমিতে রাস্তা তৈরি ও হোটেলের ভিত ভরাট করছে।
সৈকতে রাস্তা তৈরি প্রসঙ্গে হোটেল বে-প্যারাডাইজ লি.-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও জাতীয় পার্টির (এরশাদ) কেন্দ্রীয় সহসভাপতি মো. নুরুল আমিন বলেন, ‘যা কিছু হচ্ছে, আইনের বিধিবিধান অনুসরণ করেই হচ্ছে।’
সমুদ্রের তীর ঘেঁষে (সুগন্ধা পয়েন্ট) ১৩ তলা হোটেল ‘দ্য সি প্রিন্সেস’ তৈরি করছে নির্মাণ সংস্থা হোম স্টুন। হোম স্টুনের প্রকল্প পরিচালক রবি সাহা বলেন, ‘সিভিল এভিয়েশন অথরিটি আমাদের ১৪০ ফুট উঁচু ভবন নির্মাণের অনুমতি দিয়েছে। কক্সবাজার পৌরসভা তা অনুমোদন দিয়েছে। আমরা এই জমিতে ভবন নির্মাণের কাজ শেষ করেছি।’ প্রতিষ্ঠানের প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা একরামুল বশর চৌধুরী বলেন, ‘এই হোটেলের নির্মাণকাজ শেষ হবে চলতি বছরের ডিসেম্বরে। এই ভবনটি কক্সবাজার বিমানবন্দর থেকে ৪৫০০ ফুট দক্ষিণ-পশ্চিমে বলে ১৪ তলা পর্যন্ত নির্মাণ করা যাবে।’ সৈকতে রাস্তা নির্মাণ প্রসঙ্গে তিনি জানান, মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী প্রস্তাবিত শহররক্ষা বাঁধ লাইন অনুসরণ করে ৮০ ফুট প্রস্থের রাস্তাটি হচ্ছে। হোটেলে যাতায়াতের জন্য এ রাস্তা দরকার।
দ্য সি প্রিন্সেসের উত্তর পাশ ঘেঁষে তৈরি হচ্ছে ডেসটিনি গ্রুপের ডেসটিনি ক্রাউন প্যাসিফিক বিচ হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট। ইতিমধ্যে এর নয়তলা পর্যন্ত উঠেছে। ডেসটিনি ২০০০ লি.-এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান ডেসটিনি ডেভলপার্স লি. এর নির্মাণকাজ করছে। বেলা ১১টায় গিয়ে ভবনটির নির্মাণকাজ বন্ধ দেখা যায়। ভবন রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বরত আবু জাফর জানান, ভবনটির নির্মাণকাজ প্রায় শেষ।
সকাল সাড়ে ১০টায় সুগন্ধা পয়েন্টে কথা হয় ঢাকার বাড্ডা থেকে সপরিবারে বেড়াতে আসা কাদির মোল্লার (৪০) সঙ্গে। সৈকতের বর্তমান চেহারায় হতাশা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ছয় বছর আগে নিরিবিলি ঝাউবাগানের বালিয়াড়িতে কচ্ছপের ডিম পাড়ার দুর্লভ দৃশ্য দেখেছি। আর এখন কচ্ছপ ও লাল কাঁকড়ার চলাচলের দৃশ্য দেখা তো দূরের কথা, এত বহুতল ভবনের ভিড়ে সমুদ্রও দেখা যাচ্ছে না।’
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. গিয়াস উদ্দিন আহমদ হাইকোর্টের নির্দেশকে সময়োপযোগী এবং ভালো উদ্যোগ উল্লেখ করে বলেন, ‘শিগগির শহরের নাজিরারটেক থেকে ফদনারডেইল হয়ে পুরো সৈকতের সব স্থায়ী-অস্থায়ী স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে। ফদনারডেইলের কয়েক শ শুঁটকি মহাল উচ্ছেদ করতে সমস্যা হলেও হাইকোর্টের নির্দেশ আমাদের না মানার কোনো কারণ নেই। নাজিরারটেক, ফদনারডেইল চরে অন্তত ৭০ হাজার ভাসমান মানুষের বসবাস রয়েছে।’ তিনি জানান, হাইকোর্টের নির্দেশমতো আগামী তিন মাসের মধ্যে বিশেষ কমিটি করে পুরো সৈকতের সীমানা নির্ধারণ করা হবে।
পুলিশ সুপার নিবাস চন্দ্র মাঝিও একই ধরনের কথা জানান।
ভবনের ভিড়ে ঘিঞ্জি সৈকত: অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত পাঁচ-ছয় বছরে সাগরপাড়ের হোটেল মোটেল জোনের নিরিবিলি অর্কিড রেস্তোরাঁর চারপাশে প্রায় এক বর্গকিলোমিটার এলাকায় দুই শতাধিক হোটেল, মোটেল, গেস্টহাউসসহ অসংখ্য ভবন নির্মিত হয়েছে। আরও ৫০-৬০টি বহুতল ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ১৪ তলা ভবনও রয়েছে। সৈকতের আশপাশ, পাহাড় ও পাহাড়টিলায় বিভিন্ন আবাসন নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ছয় থেকে ১২ তলা ভবন (অ্যাপার্টমেন্ট) নির্মাণ করছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কক্সবাজার বিমানবন্দরের এক কর্মকর্তা জানান, সমুদ্রসৈকতের পাশে স্থাপিত বিমানবন্দর থেকে বিমান ওঠানামায় সমস্যা হয় বলে যেখানে বিমানবন্দরের পশ্চিম ও দক্ষিণ পাশের ২০-৩০ ফুট উঁচু ঝাউ গাছের মাথা কেটে ফেলতে হয়েছে, সেখানে ১০-১২ তলা অনেক ভবন নির্মিত হওয়ায় ঝুঁকি বাড়ছে।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) শুকুর আলী বলেন, কক্সবাজার পৌরসভার ছয়তলা পর্যন্ত ভবন নির্মাণের অনুমতি দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু তারা ২০-২২ তলার অনুমোদনও দিচ্ছে। সৈকতপাড়ের নরম বালিতে ১৮-২০তলা ভবন মারাত্মক ঝুঁকির।
পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারের (ইসিএ) অঞ্চলের ম্যানেজমেন্ট অফিসার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সৈকত পাড়ে এত বেশি হোটেল-মোটেল নির্মাণ ঝুঁকিপূর্ণ। অতীতে যা হয়েছে, এখন নতুন করে নির্মাণ করা হোটেল-মোটেলের ব্যাপারে আমরা নজর রাখছি।’
জেলা প্রশাসক জানান, সৈকতের অল্প জায়গায় অতীতে অসংখ্য হোটেল-মোটেল করে এটিকে ঘিঞ্জি শহর বা উন্নতমানের বস্তিতে পরিণত করা হয়েছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে এসে পর্যটকেরা উল্টো অস্বস্তিবোধ করেন। সুনামি কিংবা ভূমিকম্প হলে ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তিনি বলেন, সৈকত এলাকায় সমপ্রতি বাতিল করা ৫৯টি প্লটের জমি ১ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত করা হয়েছে। এসব জমি খালি রেখে সেখানে বিনোদন পার্ক নির্মাণসহ জনকল্যাণমূলক বিভিন্ন কার্যক্রমে পরিচালনার জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাবনামা পাঠানো হয়েছে। অচিরেই এর বাস্তবায়ন শুরু হবে।
নিয়ম না থাকলেও ছয়তলার বেশি ঊঁচু ভবন নির্মাণের অনুমতি দেওয়া প্রসঙ্গে কক্সবাজার পৌরসভার ভারপ্রাপ্ত মেয়র রাজ বিহারী দাশ জানান, এ কারণে দুই মাস আগের ভারপ্রাপ্ত মেয়র সরওয়ার কামালকে দায়িত্ব থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এখন বহুতল ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া বন্ধ রাখা হয়েছে।
তবে সরওয়ার কামাল বলেন, পৌরসভার নীতিমালা অনুসরণ করেই তিনি বহুতল ভবন নির্মাণের অনুমতি দেন। জামায়াতে ইসলামীর এই নেতা ২৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় কক্সবাজার পৌরসভার নির্বাচনে মেয়র পদে চারদলীয় জোটের সমর্থিত প্রার্থী।
ঝাউবাগানে হাজারও বস্তি: সমুদ্র সৈকতের ডায়াবেটিক হাসপাতাল-সংলগ্ন ঝাউবাগানে গিয়ে দেখা গেছে, দেড় হাজারের মতো ঝুপড়িঘর তৈরি করে বাস করছে ভাসমান ৮-১০ হাজার মানুষ। এর উত্তরে সমিতি পাড়া ঝাউবাগানেও রয়েছে চার শতাধিক ঝুপড়ি। এর উত্তরপাশে ফদনারডেইল, নাজিরারটেক এলাকার বিস্তীর্ণ সৈকত দখল করে অসংখ্য ঘরবাড়ি তৈরি করে বাস করছে ৫০ হাজারের বেশি ভাসমান মানুষ।
সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে বিশাল বালুচর দখল করে তৈরি করা হয়েছে শতাধিক দোকানপাট। সৈকতের লাবণী, বালিকা মাদ্রাসা, শৈবাল ও কলাতলী পয়েন্টরও একই অবস্থা। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত এসব স্থাপনা উচ্ছেদ শুরু হয়নি।
হাইকোর্টের নির্দেশকে স্বাগত: সৈকত এলাকার মোটেল নিটল বে রিসোর্টের ব্যবস্থাপক সোহরাব হোসেন জানান, ‘সৈকতের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে হাইকোর্টের নির্দেশকে আমরা স্বাগত জানাচ্ছি। ঝাউবাগানে অবৈধ স্থাপনা তৈরি করে ভাসমান লোকজনের বসবাসের কারণে চুরি-ছিনতাই যেমন বাড়ছে, তেমনি মাদকদ্রব্যের বেচাকেনা ও অপরাধকর্মও বাড়ছে। অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ হলে এসব বন্ধ হবে।’
কক্সবাজার হোটেল মোটেল গেস্টহাউস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম সিকদার জানান, সৈকত পাড়ে ইতিমধ্যে যেসব হোটেল, মোটেল তৈরি করা হয়েছে, তাও প্রয়োজনের তুলনায় বেশি হয়ে গেছে। ছোট এ জায়গায় (সৈকতে) আরও হোটেল-মোটেল নির্মাণ হলে পুরো শহর ঝুঁকির মুখে পড়বে।
পরিবেশবাদী সংগঠন কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি ও গ্রিন কক্সবাজারের নির্বাহী পরিচালক যথাক্রমে দীপক শর্মা ও ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, ‘হাইকোর্টের নির্দেশে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে। আমরা দ্রুত এর বাস্তবায়ন চাই।’
জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও কক্সবাজার সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি যথাক্রমে মো. আয়াছুর রহমান ও আবু তাহের চৌধুরী জানান, পরিবেশবিধ্বংসী এসব অপতৎপরতা অবিলম্বে বন্ধ করা না হলে বিশ্বের দীর্ঘতম সৈকতকে রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে। দ্রুত সৈকতের সীমানা নির্ধারণও জরুরি।

No comments:

Post a Comment