Tuesday, January 11, 2011

জীবনের অঙ্ক জনমাঙ্ক by অপূর্ব কুমার কুণ্ডু

বিশ্বায়নের ব্যাপ্তির কথা বলতে গিয়ে বলাটা সংকীর্ণ গণ্ডিতে হবে না কি উদার দৃষ্টিভঙ্গিতে হবে, সেটি একটি অমীমাংসিত প্রশ্ন। মীমাংসিত সমাধান একটিই আর তা হলো, আধার অনুপাতে ধারণক্ষমতা। জেমস ক্যামেরনের টাইটানিক চলচ্চিত্রে দেখতে পাই, ডুবন্ত জাহাজযাত্রীদের বাঁচানোর লাইফবোটে প্রথম জায়গা পায় শিশু।

তারপর নারী এবং অবশেষে অবশিষ্ট বোটে পুরুষ। পক্ষান্তরে পদাতিক নাট্য সংসদের সদ্য প্রযোজিত নাট্যকার নাসরীন মুস্তাফা রচিত, মীর মেহবুব আলম নাহিদ নির্দেশিত নাটক 'জনমাঙ্ক'তে দেখতে পাই, সমুদ্রতীরবর্তী মানুষের সমুদ্রের গ্রাসের হাত থেকে বাঁচতে, বাঁচার অবলম্বন সমুদ্রে নারীর বিসর্জন। পুরুষ নারীর ঊধর্ে্ব উঠে মানবের মধ্যে মনুষ্যত্বের জাগরণের নাটক জনমাঙ্ক মঞ্চস্থ হলো গত ৮ নভেম্বর শিল্পকলা একাডেমীর এঙ্পেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে।
নাটকের কাহিনীতে দেখা যায়, সমুদ্রবেষ্টিত এক জনপদের মানুষের জীবনযাত্রা। সমুদ্রের কড়াল গ্রাসের হাত থেকে বাঁচতে তাদের পরম নির্ভরতা সমুদ্রের দেবতায়। জনপদবাসীর কাছে বিপন্ন সময়ে নারীরা যে কত তুচ্ছাতিতুচ্ছ তা বোঝা যায় তখন, যখন সমুদ্রের গ্রাসের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া খণ্ডভূমিতে বাঁচতে মরিয়া পুরুষ-নারীর স্থানাভাবে ডুবিয়ে মারা হয় নারীদের। দুর্বল নারীদের ওপর আঘাত হেনে সবল পুরুষরা বেঁচে যায় নিজেদের মতো করে। পোয়াতি বউকে বাঁচানোর প্রশ্নে স্বামী করুণ মিনতি জানালে পোয়াতি বউকে ঠিকই বাঁচানো হয়। কিন্তু নৃশংস পুরুষ ডুবিয়ে মারে স্বামীটিকে। বিপন্ন সময় পার হলে জনপদবাসীর একমাত্র চাওয়া ভাবী সন্তান যেন কন্যা হয়। তবেই অস্তিত্বে বেঁচে রবে ভগি্ন, প্রিয়া, মায়ের ভাবী সম্ভাবনা। সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়, মা জানায় সন্তানটি তার পুত্র। শুধু পুরুষ নিয়ে কি জনপদ বাঁচে। লোকচক্ষুর আড়ালে মায়ের বুকে লালন-পালনে বেড়ে ওঠা সন্তানটি যে আসলে পুত্র না কন্যা, সেটি প্রকাশিত হয় ভূমিষ্ঠের ১২ বছর পর। পুরুষের লেলিহান লোলুপ দৃষ্টির হাত থেকে কন্যাকে বাঁচাতেই মায়ের এই মিথ্যা আশ্রয়। পুরুষ লোকের হাত থেকে নারীকে বাঁচাতে সক্ষম হলেও সমুদ্র পুরুষ দেবতার হাতে কন্যা হয় বলিদান। জনপদবাসীকে বাঁচাতেই পুরুষ সমুদ্রের দেবতার কাছে এই কন্যা বলিদান।
কন্যার বলির মধ্য দিয়ে জনপদবাসী যে শুধু সুরক্ষিত হয় তা নয়, বরং সমুদ্র দেবের আশীর্বাদে মাতৃজঠরে আসে নতুন ভ্রূণ। কিন্তু ঘুরে দাঁড়ায় জনপদবাসী। ভবিষ্যৎ সমুদ্র গ্রাসের মুখে সুনিশ্চিত মৃত্যুর সম্ভাবনা তৈরি হলেও কোনো নারীকেই যে জনপদবাসী আর সমুদ্রে বিসর্জন দেবে না, সেই দীপ্ত প্রত্যয় ঘোষণার মধ্য দিয়ে শেষ হয় নাট্যকার নাসরীন মুস্তাফা রচিত জীবনের অঙ্কের উত্তর মেলানোর নাটক 'জনমাঙ্ক'।
আলো জ্বাললেই যে আঁধার কেটে যায়, এই সহজ কথাটা জানা না থাকলে অনেক সময় ধরেই সম্ভব আঁধার দিয়ে আঁধার সরানো। নাট্যকার নাসরীন মুস্তাফা পুরো নাটকে পুরুষের নৃশংসতা আর নারীর লাঞ্ছনা-বঞ্চনা দেখাতে যত দৃশ্য, সংলাপ রচনা করলেন তাতে স্পষ্ট নাট্যকার আধুনিক সময়ে দাঁড়িয়েও মান্ধাতা আমলের বিশ্বাসে বিশ্বাসী। অন্য দেশ তো দূর অস্ত, এক বাংলাদেশের প্রশাসনে, অফিসে, ক্রীড়াঙ্গনে, ব্যবসায় এমনও বহু নারী আছেন, যাঁদের ব্যক্তিত্বের সামনে দাঁড়িয়ে কোনো পুরুষের পক্ষে বলা অসম্ভব, 'আমি নারী স্বাধীনতা চাই কি চাই না।' আমেরিকান পটভূমিতে নাট্যকার নাটক শিখলে সেখানে তিনি হয়তো দেখাতেন, ডেমোক্র্যাট থেকে হিলারি ক্লিনটন নির্বাচিত হলেন না। কারণ, তিনি নারী। কিন্তু মেজরিটি মানুষ বিশ্বাস করে, সক্ষমতার জোরেই, বর্ণ-গোত্রের ঊধর্ে্ব উঠে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। পুরুষ হওয়াটাই একমাত্র যোগ্যতা নয়।
বাংলার লোক আঙ্গিকে নাটকটি উপস্থাপনায় নির্দেশক মীর মেহবুব আলম নাহিদ যত্নবান, কল্পনাপ্রবণ, বহুমাত্রিক_কিন্তু সব মিলেমিশে গতানুগতিক। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের গতিশীল করেছেন, দৃশ্যের ভাবের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ আলো-আঁধারির ব্যবহার এনেছেন, সরাসরি আবহ সংগীতে অবস্থাকে বিশ্বস্ত করেছেন। জনপদের নাম না বলে জনপদবাসীকে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের মানুষ বোঝাতে চেয়েছেন, পক্ষান্তরে ধুতি-শাড়ি পরিয়ে নির্দিষ্ট কমিউনিটির প্রতিনিধিত্বও করিয়েছেন। প্রপসের প্রয়োগ (মোরগ, শিয়াল...) যতটা প্রয়োজনীয়, সেটের প্রয়োগক্ষেত্র বিশেষ আরোপিত। জনমাঙ্ক নাটকটি দেখে একটাই অনুভূতি, পল্লবিত বৃক্ষকে দেখা যায়, কিন্তু মাটির তলে থাকা শিকড় দেখা যায় না। অথচ কে না জানে, শিকড়ই বৃক্ষের প্রাণভোমরা। নাট্য প্রযোজনা পল্লবিত বৃক্ষের মতো। প্রযোজনার প্রাণভোমরা নাটক তথা নাট্যকারের লেখা। সেই লেখাই কিভাবে শত-সহস্র মানুষকে শত-সহস্র অবস্থান থেকে এনে এক বিন্দুতে এক করে দিতে পারে, সেটাই হোক আপাত একমাত্র আত্মজিজ্ঞাসা।

No comments:

Post a Comment