Tuesday, December 07, 2010

নৈতিকতার প্রশ্ন by কুলদীপ নায়ার

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের দেওয়া বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছিল, উইকিলিকসের তথ্য ফাঁস করাটা বিশ্বশান্তির পরিপন্থী। কিন্তু তাঁর এ বিবৃতি কি ধোপে টেকার মতো? কিংবা ওয়াশিংটনের ওপর থেকে বিশ্বাস ভঙ্গ করার যে অভিযোগ, তা-ও কোনোমতেই তলিয়ে যাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা প্রকাশিত তথ্য সম্পর্কে যে বক্তব্য প্রদান করেছেন, তাতেও মনে হয় না যে বিষয়টি গৌণ হিসেবে গণ্য হতে পারে। সংশ্লিষ্ট দেশের নেতারা যুক্তরাষ্ট্রকে এখন থেকে কিভাবে দেখবে? যে নাকি প্রকাশ্যে হাসিমাখা সুরে একরকম বলছে এবং ভেতরে ভেতরে করছে তার বিপরীত। এটা কোনোমতেই কূটনীতি হতে পারে না।
এটাকে বিশ্বাসঘাতকতা বলাই উত্তম। প্রেসিডেন্ট ওবামা, যিনি স্বচ্ছতার কথা বলে নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি যা করলেন তাকে ডবল স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে উল্লেখ করা যায়। তাঁর বাগাড়ম্বর যুক্তরাষ্ট্রের এ ঘটনাগুলোকে অবশ্যই ঢেকে দিতে পারবে না। প্রেসিডেন্ট, পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকদের বলেন যে এটা নিশ্চিতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধী শক্তির গুপ্তচরদের কাজ, তখন প্রেসিডেন্ট ওবামার নৈতিক শক্তি বলতে আর কি কিছু থাকে? তখন তাঁদের সামনে উদাহরণ হিসেবে ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারিই চলে আসে, যার পরিণতি হিসেবে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট নিঙ্নকে পদত্যাগ করতে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল।
মনে হতে পারে, যুক্তরাষ্ট্র চাইছে সুবিধাপ্রাপ্ত দেশগুলো তাদের শেখানো বুলি আওড়িয়ে যাক। তবে মিসেস ক্লিনটন কিন্তু একটা স্পষ্ট কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, প্রেসিডেন্ট ওবামা এবং তিনি ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য স্পষ্টভাবে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করতে যাচ্ছেন, যা নাকি দেশগুলো মেনে চলবে। কোন ধরনের নীতিমালা প্রণয়ন করতে চাইছেন তাঁরা? তবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, জাতীয় স্বার্থের বিষয়টি সর্বাগ্রে স্থান পাবে সে নীতিমালায়। কারণ যুক্তরাষ্ট্র মোটেও অন্যদের চেয়ে আলাদা নয়। কিন্তু এর পরও এমন ভান কেন তারা করছে, ওয়াশিংটন সর্বত্রই পরহিতার্থে কাজ করে থাকে। উইকিলিকস বিশ্বের জন্য বড় একটা কাজ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ ক্ষুব্ধ হতে পারে, কারণ তাদের সরকার বিশ্বে মার্কিন নাগরিকদের গ্রহণযোগ্যতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রকে একনায়কতন্ত্র থেকে আলাদা করার সুযোগ আছে? পাকিস্তানের কাছ থেকেও যুক্তরাষ্ট্র এককথায় অবাধ্যসুলভ একটি ঘটনাই প্রত্যক্ষ করল সম্প্রতি। যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছিল, পাকিস্তানের পারমাণবিক জ্বালানি পরিকল্পনা পরিবর্তন করা হোক। পাকিস্তান কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সে আহ্বানে সাড়া দেয়নি। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রবিষয়ক মুখপাত্র বলেছেন, পাকিস্তানের পারমাণবিক গবেষণা ক্ষেত্র থেকে জ্বালানি প্রযুক্তি স্থানান্তরের কোনো পরিকল্পনাই পাকিস্তান গ্রহণ করবে না। যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান ত্যাগ করার বিষয়টি ভারতের জন্য উদ্বেগজনক হতে পারে। তুরস্ক এবং আরব আমিরাত ভবিষ্যতে এতদবিষয়ক কোনো আলোচনায় ভারতের অংশগ্রহণকে প্রয়োজনীয় মনে করছে না। সম্প্রতি প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, দেশ দুটি পাকিস্তানকে প্রশমিত করারও চেষ্টা করছিল। মিসেস ক্লিনটনের বার্তা থেকে ভারতের সন্দেহ তৈরি হতে পারে_জাতিসংঘে স্থায়ী সদস্য হিসেবে ভারতের আসনপ্রাপ্তির বিষয়টিও। নয়াদিলি্লতে প্রেরিত ওয়াশিংটনের বার্তাটিও ভারত সরকারের জন্য সুখকর নয়। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক যেন আগের মতোই থাকে, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া দরকার।
নয়াদিলি্ল থেকে হাজার হাজার বার্তা ওয়াশিংটনে পাঠানো হয়েছে_এমন তথ্য উইকিলিকসের হাতে আছে। সবচেয়ে খারাপ বার্তাটি সম্পর্কে শিগগিরই জানা যাবে বলে মনে হচ্ছে। ভারত মনে করছে, যেহেতু উইকিলিকসের তথ্যগুলো ২০০৫ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যবর্তী সময়ের সেহেতু এগুলো যে পারমাণবিক ও প্রতিরক্ষাসংক্রান্ত তা মনে করা যায়। এটা সত্য যে পারমাণবিক চুক্তি বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ চাপের মধ্যে আছেন। অত্যন্ত আলোচিত এ ইস্যুতে কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (মার্কসসিস্ট) সোনিয়া গান্ধীর নেতৃত্বাধীন জোট থেকে বের হয়ে গেছে। নীরা রাদিয়ার বিশিষ্ট সাংবাদিক ও শিল্পপতিদের সঙ্গে টেলিফোন সংলাপ বিষয়টি রেকর্ড অবস্থায় ফাঁস হয়ে যাওয়ার কারণে এমনিতেই ভারত বেকায়দায় পড়েছে। টেলিফোন রেকর্ড বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে যে এটার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। শিল্পপতি রতন টাটাকে আদালতের শরণাপন্ন হতে হয়েছে এ বিষয়ে। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এমন অনুমতি প্রদান করে কি গণতন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করেনি?
লেখক : ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক।
দ্য ডন থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর মোস্তফা হোসেইন।

No comments:

Post a Comment