Tuesday, January 04, 2011

সারা দেশে এক দামে না বেচলে মামলা by আবুল কাশেম ও রাজীব আহমেদ

চিনি ও ভোজ্য তেল সারা দেশের খুচরা বাজারে একই দামে বিক্রি হবে। দাম ঠিক করবেন ব্যবসায়ীরা, তবে লাগাম থাকবে সরকারের হাতে। বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে বেশি দামে কেউ চিনি বা ভোজ্য তেল বিক্রি করলে সংশ্লিষ্ট পরিবেশকের বিরুদ্ধে মামলা করার সুযোগ থাকবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য-সংক্রান্ত এক নীতিমালার খসড়ায় এ কড়া ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে।
আজ মঙ্গলবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে এ-সংক্রান্ত এক বৈঠকে খসড়া নীতিমালাটির চূড়ান্ত অনুমোদন হওয়ার কথা। এটি কার্যকর হলে ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষণ করে নজরদারির মাধ্যমে বাজার স্থিতিশীল রাখা সহজ হবে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন।
‘নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ ও বিতরণ নীতিমালা-২০১০’ নামে এ খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে, চিনি ও ভোজ্য তেলের উৎপাদক, পরিশোধক, আমদানিকারক ও এফবিসিসিআইয়ের সহযোগিতায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ট্যারিফ কমিশনে বাজার মনিটরিং সেল স্থাপন করা হবে।
এ সেল একটি অভিন্ন মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি ঠিক করে দেবে। ওই পদ্ধতি অনুসরণ করেই খুচরা মূল্যসহ বিভিন্ন পর্যায়ে দাম নির্ধারণ করতে হবে। দাম নির্ধারণের ক্ষমতা ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হলেও সরকার প্রয়োজনে দাম নির্ধারণে হস্তক্ষেপ করতে পারবে। এসব নীতি মনিটরিংয়ের জন্য তিন ধরনের কমিটি করা হবে। কেন্দ্রীয়, জেলা ও উপজেলা বা থানা পর্যায়ে এই তিন ধরনের শক্তিশালী বাজার মনিটরিং কমিটি থাকবে। নীতিমালাটি চূড়ান্ত হয়ে জারি হওয়ার ৯০ দিন পর চিনি ও ভোজ্য তেলের ক্ষেত্রে বর্তমানে বিদ্যমান ডিও প্রথার পরিবর্তে পরিবেশক প্রথা চালু হবে। শুরুতে এ নীতিমালার আওতায় কেবল চিনি ও ভোজ্য তেল থাকলেও পরে অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যও এর আওতায় আনা যাবে।
খসড়া নীতিমালায় আরো বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় মনিটরিং কমিটিও প্রয়োজনে কোনো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মিলগেট ও ওয়্যারহাউস মূল্য, পাইকারি বা বিতরণ মূল্য ও খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে দিতে পারবে। এ কমিটির উপদেষ্টা হবেন বাণিজ্যমন্ত্রী এবং আহ্বায়ক হবেন বাণিজ্যসচিব। মিলমালিক বা আমদানিকারকদের কখনো পণ্যের দাম পরিবর্তন করে বাজারে ছাড়তে হলে আগেই তা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাজার মনিটরিং সেলকে অবশ্যই জানাতে হবে।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য-সংক্রান্ত এ নীতিমালার খসড়া চূড়ান্ত করতে গত রবিবার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বৈঠক করে। আজকের বৈঠকে এটি চূড়ান্ত হতে পারে বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
খসড়া নীতিমালার ১৪.৩ অনুচ্ছেদে উপজেলা/থানা মনিটরিং কমিটির কার্যপরিধিতে বলা হয়েছে, ‘কমিটি প্রয়োজন মনে করিলে কোন পরিবেশকের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট আইনে মামলা করিতে পারিবে।’ তবে এ কমিটি মূলত পরিবেশকদের কাছে বিতরণ মূল্য ও খুচরা মূল্য তদারক করবে। কোনো পরিবেশক বা খুচরা ব্যবসায়ী নির্দিষ্ট মূল্যের বেশিতে পণ্য বিক্রি করলে কমিটি মামলা ছাড়াও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রশাসনকে সুপারিশ করবে।
বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য সহনীয় ও স্থিতিশীল রাখার জন্যই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এসব উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা গেছে। সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রী মুহাম্মদ ফারুক খান ও বাণিজ্যসচিব মো. গোলাম হোসেন একাধিকবার বলেছেন, বিদ্যমান প্রথার কারণে ডিও ব্যবসায়ীরা বাজারে অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি করছেন। এ অবস্থায় পরিবেশক প্রথা চালু হলে পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে বাজার স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হবে।
গত রবিবার বাণিজ্যসচিব এ বিষয়ে বলেন, পরিবেশক প্রথা চালু হলে দেশের কোথাও খোলা ভোজ্য তেল ও খোলা চিনি বিক্রি করা যাবে না। বোতলজাত করে অথবা পলিপ্যাকে তা বিক্রি করতে হবে। মূলত পামঅয়েল ও সুপার পামঅয়েল আমদানি করে বাজারে তা সয়াবিন নামে বিক্রি করে ক্রেতাদের ঠকানো হচ্ছে। ভোক্তার হাতে পৌঁছার আগ পর্যন্ত যাতে ভোজ্য তেল ও চিনিতে কোনো ভেজাল মেশানো না যায়, সেই জন্যই খোলা ভোজ্য তেল ও চিনি বিক্রি নিষিদ্ধ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্যসচিব গোলাম হোসেন।
পরিবেশকদের ডিওর মেয়াদ ১০ দিন, হস্তান্তরযোগ্য নয় : খসড়া নীতিমালা অনুযায়ী নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিতরণের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কাজ করবে উপজেলাগুলো। একেকটি কম্পানি উপজেলা পর্যায়ে তার পণ্যের জন্য একজন পরিবেশক নিয়োগ করবে। সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রতি থানায় এক বা একাধিক পরিবেশক নিয়োগ করা যাবে। একজন ব্যবসায়ী কেবল একটি কম্পানির পরিবেশক হতে পারবেন। পরিবেশকদের তালিকা জমা দিতে হবে সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, সিটি করপোরেশনের ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসক ও বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের বাজার মনিটরিং সেলে।
পরিবেশকরা কোনো কম্পানির পণ্য উত্তোলনের সময় ব্যাংকে বা অফিসে টাকা দেওয়ার বিপরীতে মানি রিসিপ্ট ছাড়াও ডেলিভারি চালান বা ডিও পাবেন। ওই ডিওতে ক্রেতা বা পরিবেশকের নাম ও ঠিকানা ছাড়াও পণ্যের নাম, পরিমাণ, একক মূল্য ও মোট মূল্য উল্লেখ থাকতে হবে। এই ডিওর সর্বোচ্চ মেয়াদ হবে ১০ দিন। কোনো অবস্থাতেই ডিওর মেয়াদ বাড়ানো যাবে না। ১০ দিন পার হলে ওই ডিওর বিপরীতে কোনো পণ্য সরবরাহ করা যাবে না। এই ডিও কোনো অবস্থাতেই হস্তান্তর করা যাবে না। এর ফলে আগের মতো নিজেদের মধ্যে ডিও লেনদেন করে দাম বাড়ানোর সুযোগ থাকবে না বলে মনে করছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
পণ্যের ওজন মাপার ক্ষেত্রে কেজি ও তরল পদার্থের ক্ষেত্রে লিটার মাপের একক হিসেবে ব্যবহƒত হবে। এ ছাড়া সব পরিবেশককে বাধ্যতামূলকভাবে ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্টারের (ইসিআর) মাধ্যমে হিসাব সংরক্ষণ করতে হবে।
ব্যবসায়ীদের মত : শুরু থেকেই পরিবেশক প্রথা চালুর ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকা রাখছে দেশের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। সংগঠনটির সভাপতি এ কে আজাদ গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অনেক মিলমালিক ও আমদানিকারক চাচ্ছেন না যে এটা হোক। ডিও প্রথা থাকলেই তাঁরা বেশি লাভবান হন। পণ্য সরবরাহ করার আগে শুধু ডিও বিক্রি করেই অগ্রিম অর্থ পাওয়া যায়। ওই টাকা দিয়েই ব্যবসা করতে পারেন তাঁরা।’ তিনি আরো বলেন, ‘মুনাফা ছাড়াও সমাজের প্রতি ব্যবসায়ীদের দায়িত্ব রয়েছে। ঢালাওভাবে এখন ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ানোর অভিযোগ উঠছে। এ অভিযোগ থেকে ব্যবসায়ীদের বের হয়ে আসতে হবে। এ ছাড়া এমন নয় যে, পরিবেশক প্রথা সরকার ব্যবসায়ীদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। সবার সঙ্গে আলোচনা করেই সরকার এটি করতে যাচ্ছে।’
এস আলম গ্র“পের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদ গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পরিবেশক প্রথা চালু হলে অনেক ভালো হবে। পণ্য বেচাকেনায় ঝামেলা থাকবে না। পণ্যের বাজারে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হবে শতভাগ।’ এ প্রথার দ্রুত বাস্তবায়ন চেয়ে তিনি বলেন, ‘সরকারি নীতিমালার বাইরে গেলে সারা দেশে ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করে মামলা করা হোক। সরকার কঠোরভাবে এটি মোকাবিলা করুক।’
দেশের বৃহত্তম পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের আমদানিকারক বিএসআরএম গ্র“পের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নিত্যপণ্য খুচরা বাজারজাত করতে হলে প্যাকেট ও বোতলজাত করতে পারলে ভালো হয়। এতে পণ্যের দাম লেখা থাকে। কেউ রাতারাতি দাম বাড়াতে পারে না, কমাতেও পারবে না।’ তবে তিনি সারা দেশে একদামে বিক্রির বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করে বলেন, ‘বাজারে কোনো পণ্যের দাম ভিন্ন ভিন্ন হতেই পারে। কারণ আমরা আমদানিনির্ভর দেশ। একেক আমদানিকারকের ক্রয়মূল্য একেক রকম থাকবে। কারণ আন্তর্জাতিক বাজার প্রতিদিনই ওঠানামা করে। যিনি কম দামে আমদানি করবেন, তাঁর কম দামে বিক্রির সুযোগ রয়েছে। যাঁর পরতা বেশি পড়বে, তিনি তো কম দামে বিক্রি করতে পারবেন না।’
ভোক্তারা চান কম দামে পণ্য : ঢাকার মিরপুর ১৩ নম্বর সেকশনের বাসিন্দা আজিজুল হক বলেন, ‘নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য বাজার মনিটরিং, তালিকা টাঙানো, দাম বেঁধে দেওয়াসহ অনেক কিছুই করা হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ তেমন কিছুই হয়নি। এখন পরিবেশক চালু হলে যদি তেল-চিনির দাম নিয়ন্ত্রণে থাকে, তাহলে আমরা খুশি।’
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল হোসেন মিঞা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ডিও প্রথার কারণে অনেক সময় পণ্যের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়। নির্দিষ্ট সময়ে ব্যবসায়ীরা পণ্য উত্তোলন করেন না। আবার ডিও হাতবদলের কারণে পণ্যের দাম বাড়ে। ডিস্ট্রিবিউটরশিপ চালু হলে তা দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সহায়ক হবে বলে আমরা আশা করি। সারা বিশ্বেই এ ব্যবস্থা চালু আছে। সার সরবরাহে সরকার এ ব্যবস্থা সফলভাবে চালু রেখেছে। ভোজ্য তেল ও চিনিসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রে এ ব্যবস্থা চালু হলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে।

No comments:

Post a Comment