Tuesday, January 04, 2011

মালয়েশিয়ায় যাওয়ার খরচই উঠছে না by শরিফুল হাসান

রাজশাহীর শফিক মিয়া দুই লাখ ২০ হাজার টাকা খরচ করে ২০০৮ সালে মালয়েশিয়ায় এসেছেন। কৃষিশ্রমিক হিসেবে কাজ করে এখনো তিনি খরচের টাকাই তুলতে পারেননি।
মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে একটি খাবারের হোটেলে দেখা শফিক মিয়ার সঙ্গে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘মালয়েশিয়ায় যখন আসি, তখন আমার ছেলের বয়স ছিল ছয় মাস। এখন চার বছরে পা দিয়েছে। ছেলেটার মুখ খুব দেখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কী নিয়ে যাব? জমিজমা সব বিক্রি করে এসেছি। টাকা জমাতে না পারলে পথে বসতে হবে। তাই ছেলেটার কথা ভাবি আর কাজ করি।’
মুন্সিগঞ্জের রাজু আহমেদ ভাগ্য বদলাতে দুই লাখ ৬০ হাজার টাকা খরচ করে ২০০৭ সালে এসেছেন মালয়েশিয়ায়। কিন্তু ভাগ্যের পরিবর্তন তো দূরের কথা, সাড়ে তিন বছরেও খরচের টাকাটাই তুলতে পারেননি তিনি।
কুয়ালালামপুরের পেট্টোনাস টুইন টাওয়ারের সামনের রাস্তায় কথা হয় রাজুর সঙ্গে। একরাশ হতাশা নিয়ে বললেন, ‘সারা দিন পরিশ্রম করি। খালি কাজ করি। শুরুতে ৬০০ রিঙ্গিত বেতন পেতাম। এখন ৯০০ পাই। এ পর্যন্ত মাত্র দেড় লাখ টাকা বাড়িতে পাঠাইছি। পুরো টাকা যত দিন তুলতে না পারব, তত দিন মাটি কামড়ে পড়ে থাকব।’
মালয়েশিয়ায় আসা বাংলাদেশের বেশির ভাগ প্রবাসী কর্মীর এখন এ রকমই দশা। অতিরিক্ত অভিবাসন খরচ তাঁদের অনিশ্চিত জীবনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। কেউ জমি বিক্রি করে বা ধারদেনা করে এসেছেন মালয়েশিয়ায়। ভেবেছিলেন আয় করে পরিশোধ করে দেবেন। কিন্তু তিন-চার বছর কাজ করেও অধিকাংশ শ্রমিক এখনো খরচের টাকাই তুলতে পারেননি। খরচের টাকা ওঠাতে বেশি বেতনের লোভে অনেকে চলে যাচ্ছেন অন্য কোম্পানিতে। এতে কাগজপত্র-পাসপোর্ট সব হারিয়ে অবৈধ হতে হচ্ছে। শ্রমিকেরা আটকে যাচ্ছেন ফাঁদে। অনেকেই টাকা জমানোর জন্য জীবনের অনেক আনন্দ বাদ দিয়েছেন, গাদাগাদি করে থাকেন। অনেক সময় দিনে দুই বেলা খান, আবার খানও না।
মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাস এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৬ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত চার বছরে মালয়েশিয়ায় এসেছেন চার লাখ ৩৮ হাজার ৬৪০ জন বাংলাদেশি শ্রমিক। ৮৪ হাজার টাকা করে এই শ্রমিকদের দেওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে তাঁদের দিতে হয়েছে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা। গড়ে দুই লাখ টাকা ধরলে বাংলাদেশি শ্রমিকদের খরচ হয়েছে আট হাজার ৭৭২ কোটি টাকা।
অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০১০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী, গত পাঁচ অর্থবছরে মালয়েশিয়া থেকে প্রবাসী-আয় (রেমিটেন্স) এসেছে এক হাজার ১৪১ ডলার বা সাত হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা। মালয়েশিয়ার দক্ষ (প্রফেশনাল) অভিবাসী, ব্যবসায়ী এবং নতুন চার লাখ ও পুরোনো আড়াই লাখ শ্রমিক মিলে এই টাকা পাঠিয়েছেন। তার পরও গত চার বছরে শ্রমিকদের খরচ হওয়া অর্থের তুলনায় প্রবাসী-আয়ের পরিমাণ কম।
ছয় লাখ শ্রমিক চার বছরে সাত হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা পাঠালে গড়ে একজন শ্রমিক পাঠিয়েছেন এক লাখ ৩৩ হাজার ৬৬ টাকা। এই হিসাবে এক বছরে পাঠানো টাকার পরিমাণ ৩৩ হাজার টাকা এবং মাসে প্রায় তিন হাজার টাকা। অর্থাৎ একজন শ্রমিক তিন বছরের চুক্তিতে দুই লাখ টাকা খরচ করে এসে চার বছরে মাত্র এক লাখ ৩৩ হাজার টাকা আয় পাঠাতে পেরেছেন। সুতরাং খরচের বাকি অর্থ তুলতে ত্াদের অবৈধভাবে আরও দুই বছর থাকতে হবে।
মালয়েশিয়ার জাতীয় ব্যাংক ব্যাংক নিগারার বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মালয়েশিয়া থেকে একজন বিদেশি শ্রমিক গড়ে তিন হাজার টাকা দেশে পাঠায়। এশিয়া অঞ্চলের অভিবাসন ও প্রবাসী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করে বেসরকারি সংস্থা কারাম এশিয়া। এই সংস্থার গবেষণা প্রতিবেদনেও একই রকম তথ্য এসেছে।
দুশ্চিন্তায় প্রবাসীরা: ‘কলিং’ ভিসায় আসা বাংলাদেশিদের তিন বছর মালয়েশিয়ায় থাকার অনুমতি রয়েছে। কিন্তু প্রবাসীরা বলছেন, তিন বছরে তাঁরা নিজেদের খরচের টাকাই তুলতে পারেননি। তাই দেশে ফেরার কথা ভাবছেন না। বরং পুলিশের গ্রেপ্তারের আতঙ্ক আর অবৈধদের সমস্যা নিয়েই তাঁরা থাকবেন।
মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুরে বাড়ি শাহীন আলমের সঙ্গে কুয়ালামপুরের বাতুকেপস চুঙ্গাইদুয়া এলাকায় দেখা। তিনি জানালেন, জমিজমা বিক্রি করে আড়াই লাখ টাকা খরচ করে এসেছেন। প্রথম চার মাস কোনো কাজ ছিল না। পরে লোহার ফ্যাক্টরিতে কাজ পান। অমানবিক পরিবেশে দিনে ১৪ ঘণ্টা কাজ করেন, বেতন মাত্র ৯০০ রিঙ্গিত। শাহীন বলেন, ‘খরচের টাকা তুলে আরও কয়েক লাখ টাকা না নিয়ে দেশে ফিরতে পারব না।’
টঙ্গীর আরিফুল ইসলাম দুই লাখ ৩০ হাজার টাকা খরচ করে এসেছেন। ফার্নিচারের একটি দোকানে কাজ করেন তিনি। শুরুতে ৪০০ রিঙ্গিত পেতেন, এখন পান এক হাজার রিঙ্গিত। তিনি জানালেন, ‘টাকা না নিয়ে বাড়ি ফেরার কোনো ইচ্ছে নেই। যত কষ্টই হোক, খেয়ে না-খেয়ে এখানে থাকতেই হবে।’ চুয়াডাঙ্গার মোমিনপুরের জাহাঙ্গীর আলমেরও একই কথা, ‘সাড়ে তিন বছরে কেবল খরচের টাকা তুলেছি। কিছু টাকা জমাতে না পারলে দেশে ফিরতে পারব না। তাই অবৈধ হলেও থাকতে হবে।’
বরগুনার বাদল মায়ের গয়না বেচে দুই লাখ ১০ হাজার টাকা খরচ করে এসেছেন আড়াই বছর আগে। যত দিন পর্যন্ত টাকা তুলতে না পারবেন, কাজ করবেন। চট্টগ্রামের নুরুল আমিন বলেন, ‘খরচের টাকা তুলতে না পারলে এখানে আসার কোনো মানে থাকবে না। তাই যত কষ্টই হোক, থাকতে হবে।’ একই পরিস্থিতি বগুড়ার উজ্জ্বল হোসেন, রাজধানীর বাসাবো এলাকার কদমতলার আবদুর রাজ্জাকসহ আরও অনেকের।
কম খরচে কুয়ালালমপুরের কোতারিয়ার বাংলা মার্কেট এলাকায় খেতে আসেন অনেকে। এখানকার রাজধানী রেস্টুরেন্টের মালিক কাজী সালাউদ্দিন ২০ বছর ধরে মালয়েশিয়ায় আছেন। জানালেন, সব শ্রমিকের একই সমস্যা। এবার তাঁদের কাছ থেকে এত বেশি টাকা নেওয়া হয়েছে যে খরচের টাকা তুলতেই অনেকের জীবন চলে যাচ্ছে। অনেকের খাওয়ার টাকাও থাকে না। অনেকে শুধু ডাল দিয়ে ভাত খেয়ে চলে যান।
মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব (শ্রম) মাসুদুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে যাঁরা এখানে আছেন, তাঁরা ভালো আয় করছেন। কিন্তু কলিং ভিসায় যাঁরা এসেছিলেন, তাঁরা কিছু সমস্যায় পড়েছেন। প্রথম দিকে কাজ পাননি। সে সময় তো ভয়াবহ অবস্থা হয়েছিল। সেই তুলনায় এখন পরিস্থিতি ভালো। সবাই কাজ পেয়েছেন। যত দিন যাচ্ছে, তাঁদের বেতনও বাড়ছে।
বেসরকারি সংস্থা কারাম এশিয়ার প্রধান হারুন-অর-রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, উন্নয়নশীল অনেক দেশ এখন যেকোনো মূল্যে তার শ্রমিকদের বিদেশে পাঠিয়ে রেমিটেন্স আনতে চাইছে। সরকারগুলো ভাবছে, বিদেশে শ্রমিক পাঠালে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু অতিরিক্ত অভিবাসন খরচ আর প্রতারণার চক্রে পড়ছেন সাধারণ শ্রমিকেরা। খরচের টাকা তুলতে গিয়ে তাঁদের মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে। যাঁর দক্ষতা ও শিক্ষা যত কম, তাঁর ক্ষেত্রে এই সমস্যা তত বেশি। এভাবে টাকার পেছনে দৌড়াতে গিয়ে একজন শ্রমিক তাঁর সব অধিকার হারাচ্ছেন।

No comments:

Post a Comment