Tuesday, January 04, 2011

আ.লীগের একলা চলা ও শরিকদের অবহেলা by জাহাঙ্গীর আলম

রকারে অংশীদারি থাকলেও গত দুই বছরে মহাজোটের শরিকদের মধ্যে খুব একটা সমন্বয় বা যোগাযোগ ছিল না। বলা যায়, অনেকটা নিষ্ক্রিয় ছিল মহাজোটের কর্মকাণ্ড। আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়েছে হাতে গোনা কয়েকটি। ক্ষমতায় আসার পর সরকারের একলা চলার প্রবণতা কখনো কখনো শরিকদের ক্ষুব্ধ করেছে।

বড় দল হিসেবে শরিকদের গুরুত্ব কম দেওয়া বা অবহেলা করার অভিযোগ রয়েছে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। প্রকাশ্যে কিছু না বললেও প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি নিয়ে মহাজোটে ক্ষোভ-বেদনা আছে। তবে পৌরসভা নির্বাচন ঘিরে সম্প্রতি মহাজোটের তৎপরতা বেড়েছে।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দল ও জাতীয় পার্টির সমন্বয়ে গড়া মহাজোট ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি ১৪ দলের শরিক সাম্যবাদী দলের দিলীপ বড়ুয়া ও জাতীয় পার্টির জি এম কাদেরকে নিয়ে মহাজোটের মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়। ১৪ দলের অপর দুই শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন ও জাসদের হাসানুল হক ইনুকে মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়। জাতীয় পার্টির আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও মজিবুর রহমানকেও সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি করা হয়। ১৪ দলের দুই শরিক ন্যাপের আমেনা বেগম ও গণতন্ত্রী পার্টির রুবী রহমানকে সংরক্ষিত মহিলা আসনে সাংসদ মনোনীত করা হয়।
এসব প্রাপ্তি সম্পর্কে শরিক দলের নেতাদের মত হচ্ছে, পদ বা সরকারে অবস্থান বড় কথা নয়। দল হিসেবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে কি না, সেটাই দেখার বিষয়। তাঁদের অভিযোগ, সরকারের সার্বিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে মহাজোটকে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে না। কেন্দ্রীয় পর্যায়ে অংশীদারিত্ব থাকলেও জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সমন্বয় নেই। এ কারণে মফস্বল পর্যায়েও শরিক দলের নেতাদের মধ্যে ক্ষোভ-বিক্ষোভ আছে।
শরিক দলের নেতারা মনে করেন, মহাজোট নিষ্ক্রিয় থাকায় সরকারের সাফল্য অনুধাবন করা সম্ভব হচ্ছে না। মহাজোটে অংশীদারিত্ব অনুধাবন করা গেলে আরও অনেক দূর এগোনো সম্ভব হতো।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য ওবায়দুল কাদের এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, শরিকদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো দরকার। সমন্বয়ের উদ্যোগ নেওয়ার দায়িত্বও বড় দল হিসেবে আওয়ামী লীগের।
সরকার গঠনের পর প্রথম বর্ষপূর্তিতে প্রধানমন্ত্রীর তখনকার সরকারি বাসভবন যমুনায় মহাজোটের সব শরিকদের নিয়ে প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এ বৈঠকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদসহ শরিকদের শীর্ষ নেতারা অংশ নেন। এরপর এক বছরে ১৪ দল ও মহাজোটের কয়েকটি বৈঠক হয়। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও শরিক দলের নেতাদের কথাবার্তা হয়। এরই মধ্যে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে মহাজোটের সমন্বয়ক করা হয়। গত নভেম্বরে ১৪ দলের বৈঠক মাসে একবার হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এক মাস পর গত ৩১ ডিসেম্বর ১৪ দলের মাসিক বৈঠক হয়। পৌরসভা নির্বাচনে প্রার্থী সমর্থন নিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাসহ দলের সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে জাতীয় পার্টির কয়েক দফা বৈঠক হয়। জাতীয় পার্টিকে ১৯টি পৌরসভায় মহাজোটগতভাবে প্রার্থী সমর্থন দেওয়া হয়।
ক্ষোভ-বেদনা থাকলেও গত দুই বছর শরিকদের কেউ মহাজোটের ঐক্য-পরিপন্থী কিছু বলেনি। সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় এমন কোনো বক্তব্যও কেউ দেয়নি। বরং মহাজোটের প্রয়োজনীয়তা এবং একে আরও সক্রিয় করার ব্যাপারে শরিকদের সবাই এক বাক্যে একমত।
শরিকদের মধ্যে জাতীয় পার্টির অভিযোগ বেশি। জাপার নেতারা বলেন, গত দুই বছরে মহাজোটের এজেন্ডাভিত্তিক কোনো বৈঠক হয়নি। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাঁদের সম্পৃক্ত করা হচ্ছে না। এইচ এম এরশাদকে মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষ দূত করার বিষয়টিও এগোয়নি।
সরকারের অবস্থান সম্পর্কে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাতীয় পার্টির এক নেতা বলেন, ‘আমরা প্রধানমন্ত্রীকে ছেড়ে যাইনি। উনিও আমাদের বের করে দেননি, আমাদের রেখেছেন।’
জাতীয় পার্টির নেতাদের অভিযোগ, পৌরসভা নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে ১৯টিতে সমর্থন দেওয়া হলেও আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থীরা সেসব পৌরসভা থেকে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেননি। জাপার মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, জনগণের কল্যাণে মহাজোট নামে যে ঐক্য স্থাপিত হয়েছে, তা থাকবে। কিছুটা মান-অভিমান থাকলেও মহাজোটের ঐক্য জোরদার করার বিকল্প নেই।
১৪ দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মহাজোটে লিয়াজোঁ শিথিল। এটা বাড়ানো দরকার। তা ছাড়া ভারতসহ অনেক দেশেই শরিক দলের মধ্যে ‘কোর’ কমিটি থাকে। এটা এখানে নেই। মহাজোটে কোর কমিটি থাকলে ভালো হতো। জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও মহাজোটকে কার্যকর রাখা দরকার। তাঁদের মতে, বিরোধী দল এ মুহূর্তে উঠে-পড়ে লেগেছে। তাই মহাজোট কার্যকর রাখা জরুরি। তাঁদের অভিযোগ, পৌরসভা নির্বাচন নিয়ে ১৪ দলে কার্যকর কোনো আলোচনা হয়নি। কিছু জায়গায় ছাড় দেওয়া হলেও বিদ্রোহী প্রার্থীর ছড়াছড়ি রয়েছে।
১৪ দলের অন্যতম শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন প্রথম আলোকে বলেন, অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক ভিত্তিতে ১৪ দলের ঐক্য আরও শক্তিশালী করা দরকার।
১৪ দলের আরেক নেতা জাসদের হাসানুল হক ইনু বলেন, মৌখিকভাবে ঐক্যের প্রতি সমর্থন দেখানো হলেও মিত্রদের মহাঐক্যকে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ গাফিলতি দেখিয়েছে। বিগত সময়ে তাদের একলা চলার নীতিটাই প্রাধান্য পেয়েছে। ঐক্যের অংশীদারদের অবহেলা ও উপেক্ষা করা হয়েছে।
শরিকদের এসব অভিযোগ সম্পর্কে আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের সব কথা যে সঙ্গত, তা ঠিক নয়। আবার ক্ষোভ-বিক্ষোভও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে যোগাযোগ বাড়ানো দরকার। বসাবসি হলে দূরত্ব কমে, সম্পর্ক বাড়ে।

No comments:

Post a Comment